জনপ্রিয় অনলাইন : দালালের মাধ্যমে স্পেন গিয়ে এখন
হাসপাতালের হিমাগারে নিথর পড়ে আছে সুনামগঞ্জ শহরতলির ইব্রাহিমপুর গ্রামের যুবক আমির
হোসেন জুনেদ। প্রায় আড়াই মাস আগে মরোক্ক থেকে স্পেনে যাওয়ার সময় দালালদের শারীরিক ও
মানসিক নির্যাতনে ভূমধ্যসাগরে দরিয়ায় অভুক্ত থেকে মারা যায় সে।
বর্তমানে তার মরদেহ স্পেনের ম্যালিয়া হাসপাতালের হিমাগারে
পড়ে আছে। এখন টাকার প্রলোভন দেখিয়ে স্বজনরা যাতে লাশ আনার প্রক্রিয়া না করেন সেজন্য
পরিবারকে ভয়ভীতিও দেখাচ্ছে। সরেজমিন আমির হোসেন জুনেদের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের বুকফাটা
কান্না লক্ষ্য করা গেছে। আমির হোসেন ইব্রাহিমপুরের আলাউদ্দিনের ছেলে।
পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৮ সালের মার্চ মাসে
সুনামগঞ্জ শহরের বাধনপাড়া আবাসিক এলাকার মাওলানা আনোয়ার হোসেন, (কথিত ঢাকাইয়া) তার
ছেলে মাওলানা হোসাইন আহমদ, হোসাইন আহমদের ভগ্নিপতি সিরাজ মিলে আমির হোসেন জুনেদকে স্পেনে
পাঠানোর প্রক্রিয়া করে। জুনেদের বাবা আলাউদ্দিন প্রথমে হোসেনকে ৬ লাখ টাকা দেন। পরে
তার বোন খালেদার একাউন্টেও টাকা পাঠান।
খালেদার স্বামী সিরাজ বাইরের দালালদের সঙ্গে সমন্বয় রাখেন।
শুরু থেকেই পরিবারের লোকজন মাওলানা আনোয়ার, তার ছেলে হোসেন ও জামাতা সিরাজের সঙ্গেই
জুনেদের বিষয়ে কথা বলেন। এদের মাধ্যমেই বাড়ি থেকে বের হবার পর ছেলের খোঁজ ও অবস্থান
জানতেন তারা।
চুক্তি অনুযায়ী হোসেন ও সিরাজ মিলে প্রথমে জুনেদকে দুবাই
পাঠায়। দুবাই প্রায় ৬ মাসেরও অধিক জুনেদ অবস্থান করে। তাকে দালালরা বন্দিশালায় রেখে
নির্যাতন করে, অবর্ণনীয় কষ্ট করে। তবে এই সময় হোসেন ও সিরাজের মাধ্যমে খবর নিতেন পরিবারের
লোকজন।
মাঝে মধ্যে দালালরা জুনেদের সঙ্গে যোগাযোগও করিয়ে দিত। তবে
দুবাই থেকে অবৈধভাবে সাগরপথে মরোক্ক পাঠানো হয় জুনেদকে। তখন জাহাজে তুলে আরো টাকা পাঠানোর
জন্য নির্যাতন করে। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করিয়ে দিত দালালরা। এ সময় পরিবারের লোকজন
আনোয়ার, হোসেন ও সিরাজের সঙ্গে কথা বলে সিরাজের স্ত্রীর একাউন্টে টাকা পাঠান।
এভাবে প্রায় ১৮ লাখ টাকা দালালের হাতে তুলে দেন আলাউদ্দিন।
কিন্তু দুবাই থেকে মরোক্ক হয়ে স্পেন যাওয়ার পর দীর্ঘদিন জুনেদের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি
স্বজনরা। মারা যাবার আগ পর্যন্ত দুইবার কয়েক মিনিট কথা বলার সুযোগ দেয় দালালরা। তবে
টাকা পাঠানোর জন্য নির্যাতন করে জুনেদের কণ্ঠ শুনাতো দালালরা।
জানা গেছে, মাওলানা আনোয়ার, তার ছেলে হোসাইন ও মেয়ে জামাই
সিরাজ মিলে ইব্রাহিমপুর গ্রামের টিপু ও জাহিদুলকেও স্পেনে পাঠানোর প্রক্রিয়া করে। এই
দুজনের কাছ থেকেও বেশ কিছু টাকা নেয়। টিপু দুবাই গিয়ে দালালদের তৎপরতা বুঝতে পেরে কৌশলে
ফিরে আসার আকুতি জানালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। জাহিদুল ভারত থেকেই ফিরে আসেন। যার ফলে
এই দুজনের ভাগ্যে বিপদ নেমে আসেনি।
গত ২৬ নভেম্বর ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে ৭৯
জনকে উদ্ধার করে উদ্ধারকর্মীরা। এর মধ্যে জুনেদসহ ১৮ জন বাংলাদেশি ছিলেন। জুনেদকে মুমূর্ষু
অবস্থায় উদ্ধারের ছবিসহ সংবাদ প্রকাশিত হয় স্পেনের দৈনিক ‘এলপাইস’ পত্রিকাসহ সেদেশের
বিভিন্ন অনলাইনে। তার পরিচয় উদ্ধার করে স্পেনের বাংলাদেশ দূতাবাস জুনেদের মৃত্যুর খবর
পরিবারকে অবগত করে এবং সরকারিভাবে লাশ নিতে আহবান জানায়।
গত ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার ও মিশন উপ-প্রধান
এম হারুন আল রাশিদ ম্যালিয়ায় গিয়ে জুনেদের লাশ শনাক্ত করেন। পরে দূতাবাসের মাধ্যমে
পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ও সরকারি খরচে লাশ আনার কথা জানান।
এদিকে জুনেদের মৃত্যুর পর চতুর দালালরা জুনেদের পরিবারকে
বুঝাতে সক্ষম হয় মৃত সন্তানকে আর পাওয়া যাবে না। মামলা মোকদ্দমায় না গিয়ে টাকা আদায়ের
জন্য প্ররোচনা দেওয়া হয়। মাওলানা আনোয়ার হোসেন ও তার ছেলে হোসাইনের সঙ্গে পরিবারের
কয়েকজন স্থানীয় গণ্যমান্যদের নিয়ে ঘরোয়া বৈঠকও হয়। এমনকি ছেলের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার
পরও স্বজনরা দালালের কথায় বিশ্বাস করে এখন পর্যন্ত মামলা মোকদ্দমা থেকে বিরত রয়েছেন
বলে জানা গেছে। এই দালালরাই জুনেদের লাশ না আনতে নিষেধ করছে তার পরিবারকে। সরেজমিন
ঘটনাস্থলে গিয়ে এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এসব তথ্য।
সুনামগঞ্জ অ্যাসোসিয়েশন ইন কাতালোনিয়ার সভাপতি মনোয়ার পাশা
বলেন, জুনেদের লাশ শনাক্ত হওয়ার পর তার তথ্য সংগ্রহ করে আমরা জুনেদের পরিবারের সঙ্গে
যোগাযোগ করেছি। দূতাবাসকে তথ্য দিয়েছি। কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি দালালরা জুনেদের পরিবারকে
লাশ না নিতে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। এমনকি তারা টাকার প্রলোভনও দেখাচ্ছে।
জুনেদের বাবা আলাউদ্দিন বলেন, আমি সুদে এনে ধার-দেনা করে
মাওলানা আনোয়ার ও তার ছেলে হোসাইনের হাতে প্রথমে ৬ লাখ টাকা দিয়েছি। পরে বিদেশে নেওয়ার
পর আমার ছেলেকে নির্যাতনের খবর পেয়ে হোসাইনের বোন খালেদা ও তার স্বামী সিরাজকে ৫ লাখ
টাকা দিয়েছি। এভাবে কয়েক দফায় ১৮ লাখ টাকা দিয়েছি। আমার ছেলেকে তো আর ফিরে পাব না।
নিঃস্ব আমি টাকা ফেরত চাই। এই টাকা দিবে বলে দালাল আনোয়ার, হোসাইন ও জুনেদ বারবার তারিখ
করছে।
চাচা জালাল উদ্দিন আহমদ বলেন, ঢাকা থেকে ফোন করে জুনেদের
লাশ আনার জন্য আমাদের সঙ্গে কারা যেন যোগাযোগ করেছে। আমরা যেহেতু মানুষ আর ফিরে পাব
না তাই লাশ আনার চিন্তা বাদ দিয়েছি। জুনেদের বাবা ঋণ করে ১৮ লাখ টাকা দিয়েছে। আমরা
সেই টাকা ফেরত চেয়েছি। একাধিকবার তারিখ ও ঘরোয়া বৈঠক করেও আনোয়ার, হোসাইন ও সিরাজ টাকা
দিচ্ছে না। এরা সবাই মিলে স্পেনে নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আমার ভাতিজাকে হত্যা করেছে।
এদের বিচার চাই আমরা।
মাওলানা আনোয়ার হোসেন ও তার ছেলে হোসাইনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ
করলেও তারা কেউ ফোন রিসিভ করেনি।
সুনামগঞ্জ পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে
কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। তবে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব। দালালের প্রলোভনে পড়ে ঝুঁকি
নিয়ে এভাবে যুবকদের বিদেশে পাড়ি না জমানো বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রচারণা চালানোর আহবান
জানান তিনি।
Post A Comment:
0 comments: