এ টি এম তুরাব, বিয়ানীবাজার: তরুণদের কাছে ইউরোপী মানেই যেন সুখ-শান্তি ও উচ্চবিলাসী
জীবন যাপন। আর এজন্য যে কোনো মূল্যে ইউরোপে যেতে চায় তারা। মাত্র কয়েক দিনে বাংলাদেশ
থেকে লিবিয়ায় এরপর সাগর পেরোলেই স্বপ্নের দেশ ইতালি। সেখানে যা আয় হবে, অন্তত ৩ চার
মাসেই দেশে অট্টালিকা বাড়ি করা যাবে। পরিবারের মানুষ সুখে-শান্তিতে থাকবে। এরকম দুয়েকটি
মিথ্যা গল্প শুনিয়ে সিলেটী (সিলেট) তরুণদের উদ্বুদ্ধ করছে মানবপাচারকারীরা। সে অনুযায়ী
তরুণদের কাছ থেকে নেয়া হয় জনপ্রতি ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা। করা হয় দালালদের সাথে চুক্তি
হয়। নিশ্চিত মৃত্যুঝুঁকি জেনেও ‘জীবনের মোড়’ঘুরে নেয়ার জন্য তারা এই পথ বেছে নেন। দালালদের
এমন প্রলোভনের কথায় অনেকে পরিবারের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করেও তাদের ইউরোপে যাওয়া হয়নি।
ভূমধ্যসাগরের নৌকা ডুবে সাগরের লোনা পানিতে তাদের স্বপ্ন ফিঁকে হয়ে যাচ্ছে। অকালে নিভে
যাচ্ছে সিলেটের তরুণ ও যুবকদের জীবন প্রদীপ।
গত
৩ বছরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে পাড়ি দিতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে ভয়ঙ্কর জলপথে মারা যান
সিলেটের শত শত তরুণ ও যুবক। নিখোঁজ রয়েছেন হাজারো মানুষ। সন্তান হারিয়ে বাবা-মা ও
আত্মীয় স্বজনের আহাজারি যেন কোন ভাবেই থামছে না। আর এসব হতভাগ্য পরিবারগুলোতে চলছে
শোকের মাতম।
সাগরে
নৌকা ডুবে ভাগ্যগুণে বেঁচে যাওয়া কয়েকজন যুবক ও তরুণ গত কয়েক দিন পূর্বে নিঃস্ব অবস্থায়
বাংলাদেশে ফিরেছেন। তাদের মধ্যে সিলেটের ৩ জন দৈনিক জালালাবাদের মুখমুখি হন। শোনালেন
স্বপ্নের দেশে ছুটতে গিয়ে জীবন বিপন্ন হওয়ার কথাগুলো- তারা হলেন সিলেটের দক্ষিণ সুরমার
লালাগাওয়ের ছাইদুল ইসলাম জাবের, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কটালপুরের মুহিদপুর গ্রামের বিলাল
ও সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাও ইউনিয়নের ঘোপাল গ্রামের রুবেল আহমদ।
তাদের
আতঙ্ক আর ধকল এখনো কাটেনি। রাতে ঘুমতে গেলে হঠাৎ সেই ভয়ানক দৃশ্যগুলো চোখে ভেসে উঠলে
পুরো শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়। শরীর কাঁপতে থাকে, ওই রাতে আর কোন ভাবেই ঘুম হয় না। জাবের,
বিলাল ও রুবেল জানিয়েছেন, সেদিন (৯ মে) তিউনিসিয়ার উপকূল থেকে নৌকাটি ছাড়ার মাত্র ১৫
মিনিটের মধ্যে উত্তাল ঢেউয়ের কবলে পড়ে তা ডুবে যায়। তাদের সহযাত্রীদের একে একে মর্মান্তিকভাবে
সাগরে ডুবে প্রাণহানির বর্ণনা দিতে গিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়েন। আর জোরেশরে বলতে
থাকেন ‘আল্লাহ কোন দূষমনকেও যেন এভাবে মৃত্যুর মুখে ফেল না। হাউমাউ করে কাঁদে কাঁদে
বলতে থাকেন, চোখের সামনে তলিয়ে যেতে থাকে মানুষ। ছোট একটি নৌকায় গাদাগাদি করে তাঁদের
জোরপূর্বক তোলা হয়েছিল। ৭৬ আরোহীর মধ্যে ৬১ জনই সাগরে ডুবে মারা যায়। আর আমরা ১৫ জন
ভাগ্যগুণে বেঁচে যাই। তারা বলেন, লিবিয়ায় ভূমধ্যসাগরের তীরে ‘গেম ঘর’নামক বন্দিশালায়
এখনো অর্ধশতাধিক সিলেটী তরুণ ও যুবকদের জিম্মি করে রাখা হয়েছে। তাদেরকে অমানবিক নির্যাতন
করা হচ্ছে। গেইম ঘরে এখনো ৫০ জনের মতো বাংলাদেশি নাগরিক রয়েছেন। এদের যেকোনো মুহূর্তে
ইতালি পৌঁছে দেয়ার কথা বলে দালালরা সাগরে ভাসিয়ে দিতে পারে। তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে সরকারের
কাছে জোর দাবী জানান তারা।
সিলেট
সদর উপজেলার কান্দিগাও ইউনিয়নের ঘোপাল গ্রামের মোঃ রুবেল আহমদ দৈনিক জালালাবাদকে বলেন,
জন্মের পর সাঁতার কেটে বড় হয়েছেন। তাই সাগরের ঢেউয়ে সাহস হারাইনি। নৌকা ডুবে যাওয়ার
পর কোনোভাবে ভেসে ছিলেন তারা কয়েকজন। পরে জেলেরা এগিয়ে এসে তাঁদের উদ্ধার করে। ৩ দিন
সাগরে ভেসে খুব কাছ থেকে দেখেছি সহযাত্রীদের মৃত্যু। এখনও চোখে সামনে দৃশ্যগুলো ভাসলে
গাঁ শিউরে উঠে।
রুবেল
বলেন, তিনিসহ আরো অনেক মানুষকে লিবিয়ায় উপকুলীয় এলাকার অন্ধকার ঘরে প্রায় এক বছর জিম্মি
রাখে মাফিরা। সেখানে তাদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালাতো। প্রতিদিন খাবারের জন্য একটি
পাউরুটি দিলেও পানিতে পেট্রোল মিশিয়ে দেওয়া হতো। পেট্রোল মিশানোর কারণ জানতে চাইলে
তিনি বলেন, যাতে যাত্রীদের ওজন কমে এবং ছোট্ট নৌকায় বেশি যাত্রী সংকুলান হয় সেজন্য
পাউরুটি ও খাবার পানিতে পেট্রোল মিশানো হতো।
রুবেল
জানান, গত ৯ মে লিবিয়ার ভূমধ্যসাগরের পাড় থেকেই শুরু হয় কথিত ‘গেইম’ট্র্যাপ। ১ ঘণ্টার
ব্যবধানে জলপথে দুটি নৌকা ইতালির উদ্দেশে সাগরে যাত্রা করে। তিউনিসিয়া সীমান্তে যাওয়ার
পর নৌকাটি নষ্ট হয়ে যায়। তারপর টানা ৩ দিন সাগরে ভেসে থাকেন নৌকার ৭৬ জন যাত্রী। একপর্যায়ে
তিউনিসিয়ার তেলবাহী একটি জাহাজের নাবিকরা নৌকা ডুবির সংবাদ পেয়ে সাহায্যে এগিয়ে আসলেও
তারা জাহাজে তোলেনি। তবে জাহাজের নাবিকরা লাইট জ্বালিয়ে আলো দিয়ে রুবেলদের সাহায্য
করেছিলেন। পরে তেলবাহী জাহাজের নাবিকরা মোবাইল দিয়ে সাগরে ভেসে যাওয়ার দৃশ্যটি ধারন
করে তিউনিসিয়া কোস্ট গার্ডের কাছে পাঠালে তাতে সাড়া দেয়নি কোস্ট গার্ড। পরে জেলেরা
এগিয়ে এসে উদ্ধার করে তিউনিশিয়ার কোস্ট গার্ডের কাছে হাস্তান্তর করেন।
তিনি
বলেন, অসুস্থ বাবা-মা, স্কুল ও কলেজ পড়–য়া চার বোনদের খরচ যোগান ও সংসারের হাল ধরতে
ভাগ্য বদলের আশায় ইতালিতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। এজন্য পারভেজ নামের এক দালালের সাথে
কথাবার্তা হয়। সে অনুযায়ী পারভেজের সাথে ৯ লাখ টাকার চুক্তি করা হয়। কথা ছিল লিবিয়া
থেকে জাহাজে করে ইতালি পাঠানোর।
২০১৮
সালের রমজান মাসে ইতালির উদ্দেশে বাংলাদেশ ছাড়েন রুবেল। তাকে প্রথমে ঢাকা থেকে বিমান
যোগে দুবাই পাঠানো হয়। সেখানে বেশ কয়েকদিন থাকার পর দুবাই থেকে-মিশর হয়ে লিবিয়া নিয়ে
যাওয়া হয়। লিবিয়া এয়ারপোর্টে নামার পর সেনা সদস্যরা তাদেরকে রিসিভ করে। এরপর সেনা সদস্যরা
ইউরোপগামীদের সেনাবাহিনীর গাড়িতে তোলা হয়। গাড়ীতে শুইয়ে তাদেরকে বস্তা দিয়ে মুড়িয়ে
সাগরের উপকূলিয় এলাকায় দালাল পারভেজের নিয়ন্ত্রনাধীন ‘গেইম ঘরে’নামক একটি ছোট্ট ঘরে
নিয়ে যায় সেনা সদস্যরা।
তিউনেসিয়া
থেকে ফেরত আরেকজন সিলেটের দক্ষিণ সুরমার লালাগাওয়ের ছাইদুল ইসলাম জাবের। তিনি ও রুবেল
এক সাথে একই নৌকায় ছিলেন এবং দুজনই গেইম ঘরে এক সাথে দীর্ঘদিন নির্যাতনের শিকারও হন
জানিয়ে জাবের বলেন, দেশে দিনমজুর হিসেবে কাজ করে খাব। তবুও আর বিদেশের নাম মুখে নেব
না। আমার কোনো শক্রকেও কোনো দিন অবৈধপথে ইতালি যেতে বলব না। ভবিষ্যতে আর কোনো মানুষকে
দালালদের খপ্পরে না পড়ার আহ্বান জানিয়ে জাবের বলেন, সাগরের প্রতিটি ঢেউ আমাদের মৃত্যুর
দূত হয়ে এসেছিল। বেঁচে থাকার আশা তো দূরের কথা কল্পনাও করিনি। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে
ও সকলের দোয়ায় আমরা কোনোমতে প্রাণে বেঁচে এসেছি।
রুবেল
আহমদ ও ছাইদুল ইসলাম জাবের দুজনই একই দালালের মারফতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ ইতালিতে
পাড়ি দিতে বিশ্বনাথ উপজেলার বৈরাগীবাজার কাতলীপড়া গ্রামের রফিক মিয়ার ছেলে পারভেজ আহমদকে
জনপ্রতি ৯ লাখ টাকা করে দুজনে ১৮ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়।
স্বপ্নের
পথে ছুটতে গিয়ে জীবন বিপন্ন হওয়ার কথা শোনালেন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কটালপুর
মুহিদপুর গ্রামের বিল্লাল। তিনি বলেন, লিবিয়ায় পৌঁছার পর তাদের রাখা হয় জুয়ারা নামের
একটি জায়গায়। সেখানে বিভিন্ন দেশের ৫৭ জন ছিলেন তারা। পরে যোগ দেন আরও ৩০ জন। জুয়ারায়
পৌঁছার পর তার পরিবারের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা নেয়া হয়। ইতালি রওনা হওয়ার আগে আরও ৪ লাখ
টাকা নেওয়া হয়।
বিল্লাল
বলেন, সিলেটের জিন্দাবাজারের নিউ ইয়াহিয়া ওভারসিজের পরিচালক এনামুল হকের মাধ্যমে গত
বছরের ডিসেম্বরের প্রথম দিকে তারা চারজন ইতালি যাওয়ার চুক্তি করেন। তিনি ছাড়া বাকি
তিনজন হলেন তার দুই ভাতিজা আবদুল আজিজ, লিটন শিকদার ও ভাগনা আহমদ হোসেন। চুক্তি অনুযায়ী
ভারত থেকে সরাসরি ইতালি যাওয়ার জন্য জনপ্রতি ৮ লাখ টাকা নির্ধারণ হয়। কিন্তু কয়েক দেশ
ঘুরিয়ে তাদের লিবিয়ার ত্রিপোলিতে নেয়া হয়।
তিনি
জানান, গত ৮ মে তাদের ৬৫ জনকে একটি ছোট নৌকায় তোলা হয়। নৌকায় তার দুই ভাতিজা ও ভাগনে
ছিল। ছোট বেলা থেকে সাঁতার কেটেছি। তাই সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে সাহস হারাইনি। নিজে বেঁচে
থাকার প্রাণপন চেষ্টার পাশাপাশি তাদেরকেও চেষ্টা করি বাঁচাতে, কিন্তু পারিনি। নিজের
চোখের সামনে ভাতিজা ও ভাগনে সাগরে ডুবে যায়।
তিউনেসিয়া
থেকে দেশে ফেরত সিলেটের ১১ জন হলেন- বিয়ানীবাজারের শাহেদ আহমদ খান, বিশ্বনাথ পালরচক
এলাকার মাছুম মিয়া, লালাবাজারের সাইদুল ইসলাম জাবের, সুনামগঞ্জের গোবিন্দগঞ্জ বালিয়াকান্দি
এলাকার মতিন মিয়া, গোবিন্দগঞ্জ তাজপুর রাজবাড়ি এলাকার হান্নান মিয়া, একই এলাকার ইকবাল
হোসেন, মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার বেড়ফুরি গ্রামের শাহেদ, হবিগঞ্জের সোহেল আহমদ,
রাশেদ ও সজিব।
যেভাবে
লিবিয়া থেকে ইতালি পাঠানোর কথা ছিল
সাড়ে
৫ লাখ টাকায় বাংলাদেশ থেকে বিমানে লিবিয়া, সেখান থেকে এক মাসের মধ্যে আরো আড়াই লাখ
টাকায় জাহাজে করে এবং লিবিয়ার সেনাবাহিনীর হেলিকাপ্টারের প্রহরায় ইউরোপগামীদের ইতালি
পৌঁছানোর কথা হয় দালালের সাথে। বাংলাদেশ থেকে ইতালি পৌছানোর জন্য মোট ৮ লাখ টাকা দিতে
হয়। সেই অনুযায়ী প্রথমে সাড়ে ৫ লাখ টাকা দেয়ার পর বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় পাঠানো হয়।
লিবিয়া পৌছার পর এক মাসের মধ্যে সেখান থেকে ইতালি পৌছানো হবে। ইতালি পৌছার পর চুক্তির
বাকি আড়াই লাখ দেয়া হবে। কিন্ত লিবিয়া পৌঁছার এক সপ্তাহের মধ্যে চুক্তির বাকি টাকা
দেওয়ার জন্য যাত্রীর পরিবারকে চাপ দেয় দালালচক্র।
কিভাবে
ইউরোপ পাড়ি দিতে হয়
প্রথম
ধাপঃ বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ইতালি পৌঁছানোর যে পথ দালালেরা ঠিক
করে দেন। ঢাকা থেকে প্রথমে ভারত। সেখান থেকে দুবাই। তারপর তুরস্ক হয়ে লিবিয়া। উড়োজাহাজে
ভ্রমণ করলেও ঢাকা থেকে লিবিয়া পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় দুই সপ্তাহ। আবার কোন কোন সময়
এর চেয়ে বেশি। দুবাই থেকে লিবিয়া পৌঁছার পর সেখানে কেউ কেউ তিন মাস আবার অনেকে এক বছরও
থাকতে হয়। এরপর সময় সুযোগ বুঝে নৌকায় করে ইউরোপগামীদের নিয়ে যাওয়া হয় তিউনিসিয়ার উপকুলে।
সেখানে পৌঁছানোর পর তাদের দেখভাল করে কথিত এক বাংলাদেশি। তার নাম ‘গুডলাক’লিবিয়ায় সে
‘গুডলাক ভাই’নামে ব্যাপক পরিচিতি।
দ্বিতীয়
ধাপঃ তিউনিসিয়ার উপকুলের নিরাপদ এলাকায় ‘গেইম ঘর’নামের একটি ছোট্ট
ঘরে রাখা হয় ইউরোপগামীদের। ঘরের সক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মানুষ থাকতে হয়। সেখানে
চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন, নিপিড়ন। এসব সহ্য করেও বেশ কিছুদিন থাকতে হয় তরুণ ও যুবকদের।
তিউনিসিয়ার উপকুল থেকে ইউরোপগামীদের ইতালিসহ ইউরোপিয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে টাকার বিনিময়ে
পৌঁছিয়ে দেয় লিবিয়ার মাফিয়ারা।
তৃতীয়
ধাপঃ গুডলাক ভাই মাফিয়া সদস্যদের চুক্তি ভিত্তিক দায়িত্ব দেন
উপকূল থেকে ইউরোপ পৌঁছাতে। এরপর ভূমধ্যসাগরে উপকূলিয় এলাকা থেকে ইতালির উদ্দেশ্যে নৌকায়
যাত্রা। ‘গেইম’ট্র্যাপ নামের এই ভয়ঙ্কর যাত্রা পাড়ি দিতে গিয়ে সাগরেই মারতে হয়েছে হাজারো
মানুষ।
টাকা
আদায়ে কৌশল
গেম
ঘরে আটকে রাখার পর থেকে প্রতি সপ্তাহে খাবারের জন্য বন্দিদের বাড়ি থেকে বিকাশের মাধ্যমে
৩হাজার টাকা দালালকে দেয়া লাগে। তাও এই তিন হাজার টাকা থেকে বন্দি ব্যক্তিকে দেয়া হতো
মাত্র ৩ শত টাকা। লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশ্যে যাত্রার পূর্ব পর্যন্ত বাড়িতে ফোন করেন
টাকা নিতে হতো।
‘গেইম
ট্র্যাপ’ কীঃ ভূমধ্যসাগরের পাড় থেকেই শুরু হয় কথিত ‘গেইম’ট্র্যাপ। জলপথে ইতালি ও ইউরোপের
অন্যান্য দেশে পাঠানোর জন্য মাফিয়া সদস্যরা সময় সুযোগ বুঝে ৮০ জন বা ৯০ জনের একটি গ্রুপকে
নৌকায় তোলা হয়। শুরু হয় যাত্রা, কিছু দূর যেতে না যেতে, সাগরের মাঝ পথে নৌকা আটকে দিয়ে
অন্য একটি নৌকাতে সকলকে তুলে। এসময় নৌকার সক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী হওয়ায় নৌকাটি
সাথে সাথে ডুবে যায়। আর এতেই প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটে।
‘গেইম
ঘরে’যেভাবে রাখা হয়
লিবিয়ায়
যাওয়ার পর সাগরতীরবর্তী এলাকায় ছোট্ট ঘর। গেইম ঘর নামক তালাবদ্ধ ঘরে ইউরোপগামীদের রাখা
হয়। শতাধিক লোককের জন্য একটি মাত্র টয়লেট। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস চলে, খাবার-গোসল
ছাড়া পড়নের কাপড় পড়ে থাকতে হয় তাদেরকে। এই গেইম ঘরে লিবিয়ার দালাল ও মাফিয়ারা জিম্মি
করে অর্থ আদায় করে। প্রতিদিন একবার মাত্র একটি করে রুটি দেয়া হত। কেউ খাবারের জন্য
এক বারের পর দুই বার কল করলে শাস্তি সরুপ সবাইকে ৭২ ঘন্টা পর খাবার দেয়া হত। একজন মাত্র
১০ মিনিট শুয়ে থাকার পর, অন্যজনকে শুবার সুযোগ দিয়ে ৪ ঘন্টা দাড়িয়ে থাকতে হয়। তাদের
এভাবেই চলে মাসের পর মাস।
কে
এই ‘গুডলাক ভাই’?
ইউরোপে
যেতে ইচ্ছুক মানুষদের লিবিয়ার উপকূল থেকে বিদায় জানানোর প্রক্রিয়া থেকে বাংলাদেশী নাসির
উদ্দিনের নাম হয়ে যায় ‘গুডলাক ভাই’। তার আসল নাম নাসির উদ্দিন, গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে।
তিনি দীর্ঘদিন ধরে লিবিয়ার ত্রিপোলিতে বসবাস করেন। আর সেখানে বসেই পুরো চক্রটি নিয়ন্ত্রণ
করছেন। তার দুই ভাই মনজু ও রিপন এই চক্রের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ হিসেবে কাজ করে। তার
দুইজন কখনো লিবিয়া আবার কখনো বাংলাদেশে বসে পুরো প্রক্রিয়া দেখভাল করে।
সুত্র : নয়া দিগন্ত ।
Post A Comment:
0 comments: