জনপ্রিয় অনলাইন : ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দুর্দান্ত সাফল্যের রেশ ধরে বিশ্বজুড়ে নানা সংস্থা গড়ে ওঠছিল। মুক্ত বাজার, অবাধ চলাচল, অভিন্ন মুদ্রার গুণগান বর্ণনা করে নানা তত্ত্ব আকাশ-বাতাস মুখরিত করে রেখেছিল। মনে হচ্ছিল, জাতিরাষ্ট্রের অস্তিত্বই বুঝি বিপন্ন হতে চলেছে। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই মুছে যাবে দেশগুলোর নাম। ইইউ, আসিয়ান, সার্ক ইত্যাদির মাধ্যমেই দেশগুলো নিজেদের পরিচিত করবে। 

কিন্তু সেটা এখন সুদূরের স্বপ্ন। খোদ ইইউই ভেঙে যাচ্ছে। ব্রিটেনের মতো দেশ তা থেকে সরে গেছে। উগ্র জাতীয়তাবাদীরা নির্বাচনে জিতলে ফ্রান্স ও জার্মানিও এত দিন বের হয়ে আসত এবং সংস্থাটি ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে পড়ে থাকত। তবে অদূর ভবিষ্যতে যে তা হবে না, তা কেউ বলতে পারে না। উদার আন্তর্জাতিকবাদের বদলে সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদের ঢেউ তীব্র বেগে আছড়ে পড়ছে খোদ ওই আঁতুরঘরেই।
এর ধারাবাহিকতায় এখন যুক্ত হয়েছে কাতালোনিয়া। গত রোববার স্পেনের এই অঞ্চলটির ৯০ শতাংশ বেশি ভোটদাতা স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়েছে। এখন তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করার যৌক্তিকতা প্রমাণ করার দাবি করছে। একসময় বার্সেলোনার মাধ্যমে রিয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে যে লড়াই চালিয়ে আসছিল, এখন সেটা সরাসরি রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে পরিণত হবে। গণ ভোটকে রুখতে সম্ভব সবকিছু করেছিল স্প্যানিশ সরকার। কিন্তু কাজ হয়নি। কাতালানদের দুর্বার আকাক্সক্ষার কাছে ভেসে গেছে তাদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা।
অবশ্য কাতালানদের স্বাধীনতার এ দাবি সহজে মানবে না স্প্যানিশ সরকার। এমনকি ইউরোপের মোড়লরাও স্বাধীন কাতালোনিয়াকে গ্রহণ করতে করতে নারাজ। কাতালোনিয়া স্বাধীন হয়ে গেলে খুবই ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে আগে থেকেই টালমাটাল অবস্থার মধ্যে থাকা স্প্যানিশ অর্থনীতি। খুব কাছেই সতর্কবার্তা হয়ে ঝুলে আছে গ্রিস ট্র্যাজেডি। গ্রিসের মতো ঋণগ্রস্ত স্পেনেরও আছে দেউলিয়া ঘোষণা হওয়ার আশঙ্কায়। ফলে স্পেনের পাশাপাশি ইউরোপের ওইসব দেশও হয়তো চাইবেন না কাতালোনিয়ার আলাদা হয়ে যাওয়া। তারা স্কটিশদের স্বাধীনতার ডাকও বানচাল করে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল। কারণ তাহলে নতুন করে আরেকটি বড় সঙ্কটের মধ্যে পড়তে হবে ইউরোপের নীতিনির্ধারকদের। এমনিতেই গ্রিস ও সাম্প্রতিক অভিবাসী পরিস্থিতি বেশ জর্জরিত করে রেখেছে তাদের। কিন্তু কাতালানরাও নাছোড়বান্দা। বহু দিনের লালিত স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে এবার বাস্তবে রূপ দিতে বদ্ধপরিকর কাতালোনিয়ার মুক্তিকামী মানুষ।
অনেক প্রাচীন ইতিহাসের অধিকারী এই কাতালোনিয়া। ১১৬৪ সাল পর্যন্ত খুবই শক্তিশালী একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল কাতালোনিয়া। তারপর এটি যুক্ত হয় অ্যারাগনের সাথে। আর ১৪৬৯ সালে অ্যারাগনের রাজা ফার্দিনান্দ ও স্পেনের রানী ইসাবেলার বিবাহবন্ধনের মধ্য দিয়ে স্পেনের সাথে মিলন ঘটে অ্যারাগন ও কাতালোনিয়ার। তখন থেকেই ধীরে ধীরে স্পেনের কেন্দ্রীয় শাসনের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে থাকে কাতালানরা। ১৭১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত করে দেয়া হয় কাতালান রাষ্ট্র। তারপর থেকেই নিজেদের স্বকীয় সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-ভাষা চর্চার স্বাধীনতা হারাতে হয়েছে বলে অভিযোগ কাতালোনিয়ার মানুষদের।
যে নিপীড়নের চরম রূপ দেখা গেছে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সামরিক শাসনের (১৯৩৯-১৯৭৫) সময়। ১৯৭০-এর দশকের শেষে স্পেনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর কাতালোনিয়াকে দেয়া হয় স্পেনের ১৭টি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা। তবে ভেতরে ভেতরে স্বাধীনতার সুপ্ত বাসনাটাও সবসময় লালন করে গেছে কাতালানরা। সেই দাবি আরো জোরালো হয়েছে ২০০৭-০৮ সালের অর্থনৈতিক ধসের পর। নানাবিধ কৃচ্ছ্রতানীতি মারাত্মক অসন্তোষ তৈরি করেছে কাতালোনিয়ায়। ২০১০ সালে কাতালানরা স্প্যানিশ সরকারকে কর দিয়েছে ৬১.৮৭ বিলিয়ন ইউরো। আর তাদের কাছে এসেছে ৪৫.৩৩ বিলিয়ন। কেন্দ্রীয় স্প্যানিশ সরকারের হাতে বিপুল পরিমাণ টাকা চলে না গেলে আরো উন্নয়ন করা যেত বলে কড়া মন্তব্য করেছিল কাতালোনিয়া সরকার। ঠিক যেন তারা স্কটল্যান্ডেরই আরেক রূপ। ব্রিটিশরা দিতে চাইছে না স্কটল্যান্ডকে স্বাধীনতা।
গত বছরের নভেম্বরে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা নিয়ে আয়োজন করা হয়েছিল একটি অনানুষ্ঠানিক গণভোট। মাদ্রিদে স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার অনেক চেষ্টা করেছিল সেটা রুখে দিতে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সফল হয়নি। ২.২ মিলিয়ন ভোটারের ভোটে বিপুলভাবে জয়ী হয়েছিল স্বাধীনতার দাবি। ৮০.৭ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছিলেন কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে। এবার আরো বেশি লোক স্বাধীন হতে চাইছে। এই দাবি যতই দিন যাচ্ছে, আরো প্রবল হচ্ছে।
কাতালোনিয়াার পরিচয়
কাতালোনিয়ার জনসংখ্যা ৭৫ লাখ। আয়তন ৩২,১১৪ বর্গ কিলোমিটার। সুইজারল্যান্ডের জনসংখ্যার সমান। স্পেনের মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ এ কাতালোনিয়ায়। স্পেনের উত্তর-পূর্বের এই প্রদেশটির রাজধানী বার্সেলোনা। এটি স্পেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী। মোট চারটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত কাতালোনিয়া : বার্সেলোনা, গিরোনা, লেইদা ও তারাগোনা।
তাদের আছে নিজস্ব ভাষাও। বার্সেলোনা বিশ্বের অত্যন্ত জনপ্রিয় শহরগুলোর একটি, ফুটবল এবং একই সাথে পর্যটনের কারণে।
কাতালোনিয়া অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। এর লিখিত ইতিহাস এক হাজার বছরেরও বেশি পুরনো।
স্পেনের গৃহযুদ্ধের আগে এই অঞ্চলের ছিল বড় রকমের স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু ১৯৩৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর স্বৈরশাসনের সময় কাতালোনিয়ার স্বায়ত্তশাসনকে নানাভাবে খর্ব করা হয়।
কিন্তু ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর সেখানকার জাতীয়তাবাদ আবার শক্তিশালী হতে শুরু করে। এবং তীব্র আন্দোলন ও দাবির মুখে ওই অঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসন ফিরিয়ে দেয়া হয়। আর সেটা করা হয় ১৯৭৮ সালের সংবিধানের আওতায়।

স্পেনের পার্লামেন্ট ২০০৬ সালে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়, যেখানে কাতালোনিয়াকে আরো কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়। কাতালেনিয়াক উল্লেখ করা হয় একটি জাতি হিসেবে। কিন্তু সংবিধানে কাতালোনিয়াকে দেয়া এরকম অনেক ক্ষমতা পরে স্পেনের সাংবিধানিক আদালত বাতিল করে দেয় যা কাতালোনিয়ার স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। পরিণতিতে তাদের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা আরো বেড়ে যায়।
Axact

Jonoprio

জনপ্রিয়২৪ একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল। বিশ্বজুড়ে রেমিডেন্স যোদ্ধাদের প্রবাস জীবন নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয় ২০০৩ সালে। স্পেনে বাংলাভাষী প্রবাসীদের প্রথম অনলাইন নিউজ পোর্টাল।.

Post A Comment:

0 comments: