সুফিয়ান আহমদ,
বিয়ানীবাজার প্রতিনিধিঃ বিয়ানীবাজার
ক্যান্সার ও জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মরণব্যাধী ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে
তামাশায় মেতে উঠেছে । তাদের এরকম তামাশায় যেমন হতাশ রোগীরা তেমনি ক্ষুদ্ধ তাদের পরিবারের
সদস্যরা। একদিকে পরিবারের মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির করুণ পরিণতি অন্যদিকে রোগী নিয়ে ক্যান্সার হাসপাতাল
কর্তৃপক্ষের তামাশা সকলের মনে সৃষ্টি করেছে নানা সন্দেহের।
কেনই বা মরণব্যাধী ক্যান্সার
রোগীদের সাথে এরকম তামাশায় মেতে উঠেছে ক্যান্সার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং দায়িত্বে নিয়োজিত
ব্যক্তিরা তা বুঝে উঠতে পারছেন না ভুক্তভোগীরা। ভুক্তভোগী পরিবারের মতে, ক্যান্সার
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত্যুর প্রহরগোনা এসব রোগীদের নিয়ে তামাশা করে বরং নিজেরাই লাভবান
হচ্ছেন আর ধুঁকে ধুঁকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর প্রহর গুণছেন তাদের প্রিয় মানুষটি। যেখানে
এই হাসপাতাল নিয়ে বিয়ানীবাজার উপজেলাবাসীসহ গোটা সিলেটবাসী আশায় বুক বেঁধেছিলো, সেখানে
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এরকম ব্যবহার সত্যিই হতাশাব্যঞ্জক।
সরেজমিনে
রোগীদের বাড়িতে গিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিয়ানীবাজার ক্যান্সার
ও জেনারেল হাসপাতালের আজব এই তামাশার কথা। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ক্যান্সার রোগীদের
চিকিৎসা সেবা প্রদানের নাম করে প্রতি বৎসর প্রবাসীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায়
করে থাকেন। কিন্তুু সরকারী অনুমোদনহীন এই হাসপাতালে দেয়া হচ্ছে না বিনামূল্য চিকিৎসা।
প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করতেও নেয়া হচ্ছে প্রাইভেট ক্লিনিকের মতো টাকা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের
এই কর্ম দেশে বিদেশে প্রকাশ পাওয়ায় দেখা দিয়েছে ক্ষোভ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শাক দিয়ে
মাছ ঢাকতে গিয়েও হচ্ছেন প্রশ্নের সম্মূখিন। সেবার নামে রোগীদের বাড়ী বাড়ী গিয়েও নানান
প্রশ্নে জর্জরিত তারা। কোথাও যেন তাদের টাই নেই। রোগীদের ছবি তুলে প্রবাসে মিডিয়ায়
প্রচার ও প্রকাশ নিয়ে রোগীদের অভিযোগের অন্ত নেই। এ নিয়ে অনুসন্ধানে গেলে বেরিয়ে আসে
রোগীদের সাথে প্রতারণার চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মরণব্যাধী
ক্যান্সারে আক্রান্ত মাথিউরা ইউনিয়নের দুয়াখা গ্রামের সাব্বির আহমদ ও কুড়ারবাজার ইউনিয়নের
খশির ছাতল গ্রামের নাজমা বেগমের বাড়িতে গেলে তাদের নিয়ে বিয়ানীবাজার ক্যান্সার ও জেনারেল
হাসপাতালের তামাশার চিত্র ফুটে উঠে।
ক্যান্সারে
আক্রান্ত মাথিউরা ইউনিয়নের দুয়াখা গ্রামের ৫ সন্তানের জনক সাব্বির আহমদ কথা বলতে না
পারলেও তাঁর ৮০ বৎসরের বয়োবৃদ্ধ মা রুপজান বিবি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন,
“ আমার ফুয়া
ছেলে) ৭ মাস থেকে ক্যান্সার রোগী। সিলেট, ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে কোন ফায়দা
হচ্ছে না। এখন আমার ছেলে বিছনাত। আমি মা হইয়া আমার ছেলের এই অবস্থা সহ্য করতাম পারছি
না। তিনি বলেন, প্রায় ২ মাস আগে ক্যান্সার হাসপাতাল থেকে এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ডাঃ জুমারাসহ
তিন জন তাদের বাড়ীতে যান। এ সময় তারা আমার ছেলের কাগজপত্র দেখিয়া এবং আমার ছেলে ছবি তুলিয়া নিয়ে গেলো। আর যাওয়ার সময়
বললেন আমরা বেশি করি টাকা লইয়া হাসপাতাল যাইতাম। তাইলে তারা আমার ছেলের চিকিৎসা করবা।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমরা এত টাকা খই পাইতাম । এর পরে তারার আর কোন খবর নাই। আমার
ছেলের কাগজরও খবর নাই। ক্যান্সার হাসপাতাল গেলে তারাও কাগজ দেন না। পরে আমার নাতি জোরে
একদিন কাগজ আনছে। তিনি আরো বলেন, লন্ডন থাকি আমার আত্মীয়রা ফোনে জানান ইন্টারনেটও আমার
ছেলের ছবি দেখিয়া আর অসুখ শুনিয়া চিকিৎসার
টাকা দিছইন। কিন্তু আমরা তো কোন টাকা পাইছি না। আমি যে রকম পারিয়ার নিজের আত্মীয় স্বজনের
কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে আমার ছেলেরে ডাক্তার দেখাচ্ছি। এ সময় যোগ হন সাব্বির আহমদের
খালাতো ভাই একই এলাকার বাসিন্দা আব্দুল বাছিত। তিনি বলেন, ক্যান্সার হাসপাতালের দায়িত্বশীলরা
এসে সাব্বির উদ্দিনকে টাকাসহ নিয়ে যেতে বললে তাদের পরিবারের কেউ টাকার কথা শুনে ওই
হাসপাতালে যান নাই। যার কারণে আমরা যেভাবে পারছি সেভাবে তাঁর চিকিৎসা করাচ্ছি। তিনি
ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার ভাইয়ের কোন চিকিৎসা করছে না বিয়ানীবাজার ক্যান্সার হাসপাতাল
কর্তৃপক্ষ, অথচ তারা প্রচার করছে তারাই না কি আমার ভাইয়ের চিকিৎসা করছে। লন্ডন-আমেরিকা
থেকে আমাদের আত্মীয়স্বজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাব্বির আহমদের চিকিৎসা হচ্ছে দেখে
আমাদের কাছে ঠিকমত তাঁর চিকিৎসা হচ্ছে কি না এ বিষয়ে জানতে চাচ্ছে। তাদের এ রকম প্রশ্নে
আমরা বিস্মিত হচ্ছি। আমরা তাদেরকে জানিয়েছি বিয়ানীবাজার ক্যান্সার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ
সাব্বির আহমদের কোন চিকিৎসা করছে না। আর আমাদের কাছ থেকে এবিষয়ে জেনে অবাক হচ্ছেন তারাও।
তিনি ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বলেন, যেখানে আমরা এই রোগীর চিকিৎসা নিয়ে চিন্তিত সেখানে বিয়ানীবাজার
ক্যান্সার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মৃত্যু পথযাত্রী এই রোগীকে নিয়ে যে কাজ করেছে, তা সত্যিই
অবাক করার মত। আমরা এমনটি অন্তত তাদের কাছ থেকে আশা করি নি। এটা বলতে গেলে রোগীর সাথে অনেকটা তামাশার শামিল।
শুধু সাব্বির আহমদ-ই নয় এরকম অসংখ্য রোগীর সাথেও একই ব্যবহার করেছে বিয়ানীবাজার ক্যান্সার
ও জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ক্যান্সার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তোলা ছবি সামাজিক মাধ্যমে
দেখে বিদেশে থাকা আত্মীয়স্বজনের বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন মরণব্যাধী রোগে আক্রান্ত
রোগীরা। এ রকমই একজন উপজেলার কুড়ারবাজার ইউনিয়নের খশির চাতল গ্রামের জরায়ু ক্যান্সার
আক্রান্ত অসহায় লাল মিয়ার স্ত্রী নাজমা বেগম। ৫০ উর্দ্ধো এই রোগী বলেন, “ ৯/১০ মাস আগে আমার বাড়িত বিয়ানীবাজার ক্যান্সার
হাসপাতালর এ্যাম্বুলেন্স লইয়া ২জন মহিলা আর ২জন পুরুষ আসেন। তারা আমার ছবি তুলিয়া লইয়া
গেল। ‘আর আমারে খইলা খইতাম তাইন তাইন আমার চিকিৎসা কররা।
আমি তান তানর হিকাইল খতা খইলাম। যাইতে তাইন তাইন টেষ্ট দিয়া গেলা। আমি সিলেট গিয়া টেষ্ট
করিয়া আইলাম। এর বাদে একদিন আমি গেলাম হাসপাতাল। তাইন তাইন খইলা থেরাপী দিতাম। যা টেখা
আয় অর্ধেক টেখা তাইন তাইন দিবা আর অর্ধেক আমি দিতাম। আমি গরীব মানুষ অত টেখা খই ফাইতাম।
এর লাগি আর গেছি না, তাইন তাইনও আর খবর রাখছইন না। তিনি বলেন, মাসখানিক আগে আমার ফাশর
বাড়ির এক চাচীএ ফোন দিছইন লন্ডন তাকি। খইলা আমার ছবি দেখছইন, আমি বেমার হুনিয়া আমার
চাছী ইতায় টেখা দিছইন। কিন্তু আমি ত কোন টেখা ফাইছি না। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, আমার
চিকিৎসার জন্য দেয়া এসব টাকা গেল কোথায় ?
মৃত্যু পথযাত্রী
এরোগীর বড় ছেলে আবুবক্কর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা গরীব হওয়ায় কি আমাদের সাথে এই
ব্যবহার করা হলো। যেখানে আমার মায়ের চিকিৎসা নিয়ে আমরা রীতিমত হিমশিম খাচ্ছি, সেখানে
ক্যান্সার হাসপাতালের দায়িত্বশীলরা কেন আমাদের সাথে এই তামাশা করলেন তা আমাদের বুঝে
আসতেছে না।
এদিকে বিয়ানীবাজার
ক্যান্সার ও জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ক্যান্সার রোগীদের সেবা দানের সংবাদ এলাকা
ভিত্তিক প্রচার করলে প্রথম দিকে বেশ কিছু রোগীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যেত। প্রথম দিকে
মাত্র ৬০ টাকা গ্রহণ করে একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ রোগীদের সেবা দিতেন। কিন্তুু বর্তমানে
তা বাড়িয়ে ৪শ’১০ টাকা করায় রোগীর সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
বলতে গেলে তা এখন শূন্যের কোটায়। অসংখ্য গরীব-অসহায় রোগী অভিযোগ করে বলেছেন, এখানে
এসে ৪’শ ১০ টাকায় ডাক্তারের সাথে সাক্ষাৎ করে ব্যবস্থাপত্র
নিয়ে সিলেট থেকে টেস্ট করিয়ে আবার সমান টাকায় রিপোর্ট দেখানোর চেয়ে একই দিনে সিলেটে
গিয়ে ৫শ টাকায় বিশেষজ্ঞ টাকার দেখিয়ে সেখান থেকে প্রেসক্রিপশন নেয়া সম্ভব। তাই এখানে
আসার প্রয়োজন নেই। রোগীরা জানান, প্রচার করা হয় বিয়ানীবাজার ক্যান্সার হাসপাতালে ফ্রি
চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। কিন্তুু এখানে এসে তার উল্টো চিত্র পাওয়া যায়। অনেক রোগী
অভিযোগ করে বলেন, বিদেশ থেকে আমাদের বলা হয় ক্যান্সার হাসপাতালে তারা টাকা দিয়েছেন,
এখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হয়। আমরা তাদের কথামতো এখানে এসে তা পাই না। তাই এ নিয়ে
আমরা প্রবাসে থাকা আমাদের আত্মীয়দের সাথে কথা বললে তারা তা বিশ্বাস না করে তর্কে জড়ান।
যুক্তরাজ্য
থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বিয়ানীবাজার ক্যান্সার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সারা দেশের
ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের সেবা করার নাম করেই তাদের কার্যক্রম শুরু করে। মরণব্যাধি
এ রোগের চিকিৎসা দেশের মানুষ একটি উপজেলা থেকে গ্রহণ করতে পারবেন এ খবরে অনেকে আশায়
বুক বাধলেও প্রথম থেকেই অনেকে এ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করতে থাকেন। এর মধ্য দিয়ে কর্তৃপক্ষ
তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন। ট্রাষ্টিদের দেয়া টাকা ছাড়াও ফান্ড রাইজিং এর মাধ্যমে
বিশাল অংকের টাকা তারা প্রবাসীদের পকেট থেকে নিয়ে আসেন। নারী পুরুষ সবাই ক্যান্সার
রোগীদের সেবার স্বার্থে বিশাল অংকের টাকা দান করতে থাকেন। সূত্রটি জানায়, হাসপাতাল
ভবণের প্রতিটি ইট বালু প্রবাসীদের দেয়া টাকার। কিন্তুু সম্প্রতি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ
প্রবাসীদের কষ্টার্জিত টাকায় নির্মিত ভবণের বিভিন্ন কক্ষ আবার বিক্রি শুরু করেছেন।
প্রবাসীদের টাকায় নির্মিত ভবণের একেকটি কক্ষ এখন একেক জনের নামে হচ্ছে। ইতোমধ্যে ২টি
কক্ষ বিক্রি করে দুই জনের নামে করে দেয়া হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রবাসী
ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, আমাদের টাকায় ভবণ নির্মাণ করা হলো। সমস্ত ই্ট বালু আমাদের
কষ্টার্জিত টাকার। কিন্তুু এখন হাসপাতাল ভবণ একে একে অন্যের নামে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে।
যা প্রবাসীদের সাথে প্রতারণার শামিল বলে ওই ব্যক্তি জানান। ওই ব্যক্তির মতে, এখানের
সমস্ত কার্যক্রম এখন বাণিজ্যিক ভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে
জানতে বিয়ানীবাজার ক্যান্সার ও জেনারেল হাসপাতালের সুপারেনটেনডেন্ট ডাঃ সজিবুর রহমানের
সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মোতাবেক রোগীদের কাছ থেকে নির্ধারিত
হারে রশিদ প্রদানের মাধ্যমে টাকা আদায় করা হচ্ছে। তবে রশিদ গুলো ডাক্তাররা তাদের কাছে
রেখে দেওয়ার কথাও জানান তিনি। তিনি জানান, গরীব রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষার ক্ষেত্রে
সামান্য ছাড় দেওয়ার নির্দেশনা তাদের কাছে রয়েছে। যা তারা দিয়ে যাচ্ছেন। এরপর ক্যান্সার
রোগীদের বিষয়ে জানতে বিয়ানীবাজার ক্যান্সার ও জেনারেল হাসপাতালের ম্যানেজার ফাতেমা-তুজ
জোহরার সাথে যোগোযাগ করা হলে তিনি অসুস্থ বলে ফোন রেখে দেন।
Post A Comment:
0 comments: