
রাজার সব সময়ই কিছু রাজসিক বৈশিষ্ট্য থাকে। পাহাড়, পর্বত,
নদী, সমুদ্র, মহাসমুদ্র, গাছপালা, পশু, পাখি, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র প্রভৃতি
সব ক্ষেত্রেই প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে রাজা রয়েছে। আল্লাহর তাবৎ মাখলুকাত অর্থাৎ সব সৃষ্টিকুলের
মধ্যে কাউকে না কাউকে আলাদা এবং স্বতন্ত্র রাজসিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। হিমালয়-আল্পস
যেমন পৃথিবীর সব পাহাড়-পর্বত থেকে আকার-আকৃতি ও বৈশিষ্ট্যে রাজার অবস্থানে রয়েছে তেমনি
নীলনদ, ভূমধ্যসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে অন্য কোনো নদী-সাগর এবং মহাসাগরের তুলনা
চলে না। বটবৃক্ষ, বাঘ, সিংহ প্রকৃতির রাজসিকতার নমুনা। তেমনি চন্দ্র-সূর্য ছাড়াও অনেক
তারকাকে আমরা চিনি ও জানি কেবল এদের অনুপম বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বিভাময়তার জন্য।
প্রকৃতির অন্যান্য সৃষ্টির মতো মানবকুলের মধ্যে যারা রাজা হবেন বলে আসমানি ফায়সালা আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে, সে ক্ষেত্রে নির্ধারিত ব্যক্তির মধ্যে রাজার যাবতীয় গুণাবলি জন্মলগ্ন থেকেই প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। যারা ভুবনবিখ্যাত ও ইতিহাসের অমর মহানায়ক হবেন, তাদের রাজকীয় লক্ষণ মাতৃগর্ভে অবস্থানকালীন সময়ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মহাবীর আলেকজান্ডারের জন্মের আগে তার মাকে স্বপ্নে দেখানো হয়েছিল। একই রূপে মহামতি সাইরাস, রাজা কৃষ্ণ, সম্রাট আকবর, জুলিয়াস সিজার, নেপোলিয়ান বোনাপার্টের মতো মহানায়কেরা মাতৃগর্ভে থাকার সময়ে তাদের পরিবারে এমন সব অতি আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছিল; যাতে তাদের ভবিষ্যৎ রাজা হওয়ার লক্ষণগুলো ফুটে উঠেছিল। হজরত ইউসুফ আ:-এর শৈশবকাল এবং স্বপ্ন, হজরত মুসা আ: জন্মপূর্ব ভবিষ্যদ্বাণী এবং জন্মপরবর্তী অলৌকিক ঘটনা, হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর জন্মপূর্ববর্তী ঘটনা, মাতৃগর্ভে থাকাকালীন ঘটনা এবং শৈশবের বহু ঘটনার মাধ্যমে তাদের সম্পর্কে ঐশী সিদ্ধান্ত পৃথিবীবাসীর কাছে স্পষ্ট করা হয়েছিল।
রাজার শারীরিক বৈশিষ্ট্য সব সময়ই অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে থাকে। তার চোখ, মুখমণ্ডল ও শরীরের গঠন দেখে লাখো মানুষের মধ্য থেকে যে কেউ তাকে আলাদা করতে পারবেন। আজো যদি কেউ সম্রাট আকবর, সম্রাট আরোঙ্গজেব কিংবা বাদশাহ হারুন-আর-রশিদের কোনো ছবির দিকে মুহূর্তের জন্যও তাকান, তবে মনের অজান্তে এক মুহূর্তের মধ্যে দর্শকের মনোজগতে প্রকৃতির রাজসিক সম্ভ্রমের বিদ্যুৎ চমকিত হয়ে যাবে। রাজার শারীরিক সক্ষমতা, যুদ্ধ করার উদ্যমতা, কর্মের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, দূরদর্শী চিন্তা ও উৎপাদনশীল পরিকল্পনাগুলো অন্য কারো সাথে তুলনীয় নয়। তেমনি তার বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা, মানুষকে ভালোবাসা এবং আপন করে নেয়ার অদ্ভুত ক্ষমতার কারণে তিনি জমিনে অমরত্ব লাভ করেন। তিনি কারো ক্ষতির চিন্তা করেন না। ক্রোধের কারণে তার ভুল হয়। মাঝে মধ্যে ভুলের পরিমাণ এত বড় হয়ে যায় যে, হাজার বছরের মানবসৃষ্ট সভ্যতাগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। মহামতি আলেকজান্ডার যখন পারস্য অভিযান করেছিলেন, তখন পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাসম্পন্ন সাম্রাজ্য ছিল সেটি। পারস্যরাজ তৃতীয় দারায়ুস ছিলেন তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভূখণ্ডের শাসক এবং সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনী এবং ধনভাণ্ডারের অধিকর্তা। রজাধানী পার্সিপোলিসের জাঁকজমক, ঐতিহ্য, আধুনিকতা ও জৌলুশের সাথে তুলনা করা যায়, এমন কোনো মহানগরী তৎকালীন দুনিয়ায় তো ছিলই না, বরং পরবর্তী হাজার বছরের মধ্যেও এমন সুন্দর ও সমৃদ্ধ কোনো রাজধানী পৃথিবীর কোনো মহারাজ নির্মাণ করতে পারেননি।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সম্রাট আলেকজান্ডার পার্সিপোলিস দখল করার পর সেখানে বিজয় উৎসব শুরু করেন এবং উৎসবের রাতে মাতাল অবস্থায় জনৈক মহিলার প্ররোচনায় রাজধানীতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দান করেন। সকালবেলা সম্রাট যখন নেশামুক্ত হয়ে ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন তখন হাজার বছরের পুরনো রাজধানীতে বসবাসের উপযোগী একটি অট্টালিকাও অবশিষ্ট ছিল না। তিনি যেমন পার্সিপোলিস ধ্বংস করেছিলেন, তেমনি মিসরের সুবিখ্যাত নগরী আলেকজান্দ্রিয়ার পতন ঘটিয়েছিলেন। শুধু আলেকজান্ডার নয়- তার সমপর্যায়ের আরো অনেক সম্রাট ক্রোধের বশে বহু নগর, মহানগর সভ্যতা ধ্বংস করেছেন বটে, কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় তারা কোনো দিন মানবের অকল্যাণ তো দূরের কথা- অকল্যাণের চিন্তাও করেননি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আলেকজান্ডারের মতো মহান শাসকেরা সব সময় নিজেদের ক্রোধের মাধ্যমে সাধিত ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে পরবর্তী জীবনে বহুবার অনুশোচনা করেছেন এবং নিজেদের সেই কর্মকে পাপ ও অন্যায় আখ্যা দিয়ে আত্মসংশোধনের চেষ্টা করে গিয়েছেন।
আধুনিককালের একটি প্রবাদবাক্য হলো- সব মহামানবই একই প্রক্রিয়ায় চিন্তা করেন। রাজাদের ক্ষেত্রে এই প্রবাদবাক্যটি একটু বেশিই প্রযোজ্য। পৃথিবীর সব মহান শাসক জনকল্যাণে হাজার বছরের ব্যবধানে প্রায় একই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। পাঠকেরা শুনে অবাক হবেন, সম্রাট আকবরই সর্বপ্রথম আমাদের সুন্দরবনের আয়তন, জীববৈচিত্র্য ও বৃক্ষরাজি নিয়ে রাজকীয় জরিপ সম্পাদন করেছিলেন। তাকে অনুকরণ ও অনুসরণ করে প্রায় তিন শ’ বছর পর ব্রিটিশরা আবারো সুন্দরবনের জরিপকাজ সমাধা করেন। পাক-ভারতের ভূমি জরিপ এবং ভূমির উর্বরতা অনুসারে কর নির্ধারণের নীতিমালা পৃথিবীতে সবার আগে চালু করেছিলেন সম্রাট আকবর। সম্রাট আকবরের অর্থমন্ত্রী রাজা টোডরমল উদ্ভাবিত ভূমি জরিপ এবং ভূমি কর ব্যবস্থা আজ অবধি সারা দুনিয়ায় বলতে গেলে হুবহু অনুসরণ করা হচ্ছে।
জনকল্যাণে মহান রাজাদের সমচিন্তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো সুয়েজ খাল। ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরকে সংযোগকারী খালটি সর্বপ্রথম খনন করান মিসরের বিখ্যাত ফেরাউন দ্বিতীয় নিকো আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে। কালের বিবর্তনে খালটি মরুভূমির মরুঝড় দ্বারা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই ঘটনার চার শ’ বছর পর পারস্য সম্রাট প্রথম দারায়ুস আবার সুয়েজ খাল খনন করেন, যা কিনা পরবর্তী ৫০-৬০ বছরের মধ্যে আবারো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। প্রথম দারায়ুসের মৃত্যুর প্রায় এগার শ’ বছর পর মুসলিম খলিফা হজরত উমর রা: তৃতীয়বারের মতো সুয়েজ খাল খনন করিয়েছিলেন, যা প্রায় এক শ’ বছর ধরে দৃশ্যমান ছিল। পরবর্তী সময়ে মিসরের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান মোহাম্মদ আলী পাশা সুয়েজ খালটিকে বর্তমান অবয়বে খনন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
মহৎ মানুষেরা যেমন সব সময় একই কায়দায় চিন্তা করেন তেমনি শয়তান, দুষ্ট ও দুর্বৃত্তরাও একই কায়দায় অপকর্ম করে আসছে সেই অনাদিকাল থেকে। আজকের প্রসঙ্গে আমরা সে দিকে যাবো না। কারণ ভালো ভালো উদাহরণের সাথে মন্দ ইতিহাস বর্ণনা করলে অসতর্ক অবস্থায় যেকোনো পাঠক মহামানবদের চরিত্র, কর্ম ও চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন। আপনারা শুনে অবাক হবেন, প্রকৃতির মহান সৃষ্টিকুলের মধ্যে পৃথিবীর মালিক এমন এক বন্ধন সৃষ্টি করে দিয়েছেন যে, আল্লাহর উত্তম সৃষ্টিগুলো সব সময় একে অপরের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তারা একে অপরের কাছে নিজেকে মেলে ধরে- পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করে, যা সচরাচর মধ্যম সৃষ্টিকুলের মধ্যে কোনো দিন ঘটতে দেখা যায় না।
পৃথিবীর সর্বকালের দুর্গম গিরিপথ হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করার সুযোগ আলেকজান্ডারই পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বহু রাজা বহুবার সসৈন্যে হিন্দুকুশ অতিক্রম করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু প্রকৃতির দয়ায় হিন্দুকুশ পর্বতমালা যেভাবে আলেকজান্ডারের পদতলে নিজেকে সমর্পিত করেছিল, সেভাবে সে আর দ্বিতীয়বার সমর্পিত হতে পারেনি। কারণ প্রকৃতি কোনো দ্বিতীয় আলেকজান্ডার পয়দা করেনি। অনুরূপভাবে তুষারাবৃত ভয়ঙ্কর দুর্গম আল্পস পর্বতমালা সসৈন্যে অতিক্রম করার দুর্লভ সুযোগ পেয়েছিলেন মহাকালের দুই মহামানব। প্রথমজন হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অন্যতম বীর সেনাপতি মহাবীর হানিবল এবং দ্বিতীয়জন হলেন বিস্ময়কর সামরিক প্রতিভাধর মহাবীর নেপোলিয়ান বোনাপার্ট। পাহাড়-পর্বতের মতো সমুদ্রের রাজা-বাদশাহরাও সব সময় তাদের মতো উন্নত শ্রেণীর মানুষজনের জন্য নিজেদের উত্তাল বক্ষ শান্ত করে দিয়েছিলেন। কলম্বাসের মতো মহানায়ক যেমন আটলান্টিক পাড়ি দিতে পেরেছিলেন, তেমনি ম্যাগিলান, ভাস্কো-দা-গামার মতো নাবিকেরা প্রকৃতির অবারিত সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার মাধ্যমেই নিজেদের কীর্তিকে অমর করার সুযোগ লাভ করেছিলেন।
প্রকৃতির দয়াপ্রাপ্ত রাজা-বাদশাহরা কোনো দিন প্রকৃতির অন্য কোনো শ্রেষ্ঠতর প্রাণী অথবা সৃষ্টিকুল দ্বারা আক্রান্ত হননি। কোনো মহান শাসক বাঘ-সিংহ থেকে যেমন আক্রান্ত হননি- তেমনি সমুদ্রেও তাদের সলিল সমাধি হয়নি। রাজারা কোনো দিন বড় বৃক্ষ নিধন করেন না- এবং বাঘ-সিংহ নিধনে নিজেদের বীরত্ব জাহির করেন না। সমুদ্র কোনো দিন পাহাড়কে নিমজ্জিত করেনি কিংবা নদী-সমুদ্রের ভাঙনে পাহাড় ধ্বংস হয়নি। আকাশের বজ্রপাত বটবৃক্ষকে আক্রমণ করে না তেমনি সাহারার প্রবল বালুঝড় কোনো পাহাড়কে আচ্ছাদিত করতে পারেনি বা কোনো দিন চেষ্টাও করেনি। সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা যেমন তুলনামূলক বেশি থাকে- তেমনি পাহাড় যত উঁচু ও বৃহৎ হবে তার মাথা তত ঠাণ্ডা থাকবে।
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে সব ভালো মানুষ কখনো নিজেরা পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-ফাসাদে জড়িয়ে পড়ে না। মহানায়কেরা প্রায় সবাই সমসাময়িককালের হয়ে থাকে এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা-সমঝোতা ও প্রীতিময় সম্পর্ক বহাল থাকে। সময়ের প্রয়োজনে অনেক মহামানব একজন অন্য জন্যের সাথে যুদ্ধ করেছেন বটে- কিন্তু কোনো দিন ভালোমানুষির সীমাটুকু অতিক্রম করেননি। আলেকজান্ডারের সময়কালে যেসব মহান শাসক দুনিয়ার বড় বড় সাম্রাজ্য শাসন করছিলেন, তাদের কারো সাথেই তার যুদ্ধ হয়নি। ভারতের নন্দ বংশ, চীনের শাসকবৃন্দ, উত্তর আফ্রিকা ছাড়াও পশ্চিম ইউরোপে তিনি অভিযান পরিচালনা করেননি। ইতিহাসের প্রায় কাছাকাছি সময়ে আলেকজান্ডার, অ্যারিস্টটল, পোন্টা সক্রেটিস, হিরোডোটাস, সাফাক্লিস প্রমুখেরা পৃথিবীতে ছিলেন। এমনতরো আরো বহু উদাহরণ ইতিহাস থেকে দেয়া যাবে।
বাদশাহ হারুন-আর-রশিদ, সম্রাট সার্লিমেন সমসাময়িক ছিলেন। তুর্কি সুলতান সুলেমান, ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞী প্রথম এলিজাবেথ, মোগল সম্রাট আকবর ও পারস্য সম্রাট শাহ তামসনও ছিলেন সমসাময়িক। মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ডেভিড লয়েড জর্জ, উইনস্টন চার্চিল প্রমুখেরা যেমন সমসাময়িক ছিলেন তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মার্শাল টিটো, জন এফ কেনেডি, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ইয়াসির আরাফাত, গামাল আবদেল নাসের, বাদশাহ ফায়সাল প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের কর্মযুগও ছিল প্রায় সমসাময়িক।
এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, প্রকৃতির মন্দ প্রাণীগুলোও কিন্তু একই সাথে জন্ম নেয় এবং একজন অন্যজনের সাথে পাল্লা দিয়ে দুনিয়ায় তাণ্ডব চালায়। তারা কখনো পরস্পর যুক্তি করে ধ্বংসলীলা চালায়- আবার মন্দলোকের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতেও পৃথিবীতে বহুমাত্রিক ধ্বংসযজ্ঞ সাধিত হয়। এখন যদি প্রশ্ন করা হয়- কেন এমনটি হয়! সে ক্ষেত্রে প্রকৃতির কার্যকারণ নিয়ে বহু গবেষক তাদের গবেষণাপত্র পৃথিবীতে রেখে গিয়েছেন। আপনার জানার আগ্রহ প্রবল হলে সেসব অমূল্য গবেষণা খুঁজে পেতে একটুও কষ্ট করতে হবে না- হাত বাড়ালেই পেয়ে যাবেন একদম নাগালের মধ্যে।
প্রকৃতির অন্যান্য সৃষ্টির মতো মানবকুলের মধ্যে যারা রাজা হবেন বলে আসমানি ফায়সালা আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে, সে ক্ষেত্রে নির্ধারিত ব্যক্তির মধ্যে রাজার যাবতীয় গুণাবলি জন্মলগ্ন থেকেই প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। যারা ভুবনবিখ্যাত ও ইতিহাসের অমর মহানায়ক হবেন, তাদের রাজকীয় লক্ষণ মাতৃগর্ভে অবস্থানকালীন সময়ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মহাবীর আলেকজান্ডারের জন্মের আগে তার মাকে স্বপ্নে দেখানো হয়েছিল। একই রূপে মহামতি সাইরাস, রাজা কৃষ্ণ, সম্রাট আকবর, জুলিয়াস সিজার, নেপোলিয়ান বোনাপার্টের মতো মহানায়কেরা মাতৃগর্ভে থাকার সময়ে তাদের পরিবারে এমন সব অতি আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছিল; যাতে তাদের ভবিষ্যৎ রাজা হওয়ার লক্ষণগুলো ফুটে উঠেছিল। হজরত ইউসুফ আ:-এর শৈশবকাল এবং স্বপ্ন, হজরত মুসা আ: জন্মপূর্ব ভবিষ্যদ্বাণী এবং জন্মপরবর্তী অলৌকিক ঘটনা, হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর জন্মপূর্ববর্তী ঘটনা, মাতৃগর্ভে থাকাকালীন ঘটনা এবং শৈশবের বহু ঘটনার মাধ্যমে তাদের সম্পর্কে ঐশী সিদ্ধান্ত পৃথিবীবাসীর কাছে স্পষ্ট করা হয়েছিল।
রাজার শারীরিক বৈশিষ্ট্য সব সময়ই অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে থাকে। তার চোখ, মুখমণ্ডল ও শরীরের গঠন দেখে লাখো মানুষের মধ্য থেকে যে কেউ তাকে আলাদা করতে পারবেন। আজো যদি কেউ সম্রাট আকবর, সম্রাট আরোঙ্গজেব কিংবা বাদশাহ হারুন-আর-রশিদের কোনো ছবির দিকে মুহূর্তের জন্যও তাকান, তবে মনের অজান্তে এক মুহূর্তের মধ্যে দর্শকের মনোজগতে প্রকৃতির রাজসিক সম্ভ্রমের বিদ্যুৎ চমকিত হয়ে যাবে। রাজার শারীরিক সক্ষমতা, যুদ্ধ করার উদ্যমতা, কর্মের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, দূরদর্শী চিন্তা ও উৎপাদনশীল পরিকল্পনাগুলো অন্য কারো সাথে তুলনীয় নয়। তেমনি তার বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা, মানুষকে ভালোবাসা এবং আপন করে নেয়ার অদ্ভুত ক্ষমতার কারণে তিনি জমিনে অমরত্ব লাভ করেন। তিনি কারো ক্ষতির চিন্তা করেন না। ক্রোধের কারণে তার ভুল হয়। মাঝে মধ্যে ভুলের পরিমাণ এত বড় হয়ে যায় যে, হাজার বছরের মানবসৃষ্ট সভ্যতাগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। মহামতি আলেকজান্ডার যখন পারস্য অভিযান করেছিলেন, তখন পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাসম্পন্ন সাম্রাজ্য ছিল সেটি। পারস্যরাজ তৃতীয় দারায়ুস ছিলেন তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভূখণ্ডের শাসক এবং সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনী এবং ধনভাণ্ডারের অধিকর্তা। রজাধানী পার্সিপোলিসের জাঁকজমক, ঐতিহ্য, আধুনিকতা ও জৌলুশের সাথে তুলনা করা যায়, এমন কোনো মহানগরী তৎকালীন দুনিয়ায় তো ছিলই না, বরং পরবর্তী হাজার বছরের মধ্যেও এমন সুন্দর ও সমৃদ্ধ কোনো রাজধানী পৃথিবীর কোনো মহারাজ নির্মাণ করতে পারেননি।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সম্রাট আলেকজান্ডার পার্সিপোলিস দখল করার পর সেখানে বিজয় উৎসব শুরু করেন এবং উৎসবের রাতে মাতাল অবস্থায় জনৈক মহিলার প্ররোচনায় রাজধানীতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দান করেন। সকালবেলা সম্রাট যখন নেশামুক্ত হয়ে ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন তখন হাজার বছরের পুরনো রাজধানীতে বসবাসের উপযোগী একটি অট্টালিকাও অবশিষ্ট ছিল না। তিনি যেমন পার্সিপোলিস ধ্বংস করেছিলেন, তেমনি মিসরের সুবিখ্যাত নগরী আলেকজান্দ্রিয়ার পতন ঘটিয়েছিলেন। শুধু আলেকজান্ডার নয়- তার সমপর্যায়ের আরো অনেক সম্রাট ক্রোধের বশে বহু নগর, মহানগর সভ্যতা ধ্বংস করেছেন বটে, কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় তারা কোনো দিন মানবের অকল্যাণ তো দূরের কথা- অকল্যাণের চিন্তাও করেননি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আলেকজান্ডারের মতো মহান শাসকেরা সব সময় নিজেদের ক্রোধের মাধ্যমে সাধিত ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে পরবর্তী জীবনে বহুবার অনুশোচনা করেছেন এবং নিজেদের সেই কর্মকে পাপ ও অন্যায় আখ্যা দিয়ে আত্মসংশোধনের চেষ্টা করে গিয়েছেন।
আধুনিককালের একটি প্রবাদবাক্য হলো- সব মহামানবই একই প্রক্রিয়ায় চিন্তা করেন। রাজাদের ক্ষেত্রে এই প্রবাদবাক্যটি একটু বেশিই প্রযোজ্য। পৃথিবীর সব মহান শাসক জনকল্যাণে হাজার বছরের ব্যবধানে প্রায় একই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। পাঠকেরা শুনে অবাক হবেন, সম্রাট আকবরই সর্বপ্রথম আমাদের সুন্দরবনের আয়তন, জীববৈচিত্র্য ও বৃক্ষরাজি নিয়ে রাজকীয় জরিপ সম্পাদন করেছিলেন। তাকে অনুকরণ ও অনুসরণ করে প্রায় তিন শ’ বছর পর ব্রিটিশরা আবারো সুন্দরবনের জরিপকাজ সমাধা করেন। পাক-ভারতের ভূমি জরিপ এবং ভূমির উর্বরতা অনুসারে কর নির্ধারণের নীতিমালা পৃথিবীতে সবার আগে চালু করেছিলেন সম্রাট আকবর। সম্রাট আকবরের অর্থমন্ত্রী রাজা টোডরমল উদ্ভাবিত ভূমি জরিপ এবং ভূমি কর ব্যবস্থা আজ অবধি সারা দুনিয়ায় বলতে গেলে হুবহু অনুসরণ করা হচ্ছে।
জনকল্যাণে মহান রাজাদের সমচিন্তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো সুয়েজ খাল। ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরকে সংযোগকারী খালটি সর্বপ্রথম খনন করান মিসরের বিখ্যাত ফেরাউন দ্বিতীয় নিকো আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে। কালের বিবর্তনে খালটি মরুভূমির মরুঝড় দ্বারা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই ঘটনার চার শ’ বছর পর পারস্য সম্রাট প্রথম দারায়ুস আবার সুয়েজ খাল খনন করেন, যা কিনা পরবর্তী ৫০-৬০ বছরের মধ্যে আবারো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। প্রথম দারায়ুসের মৃত্যুর প্রায় এগার শ’ বছর পর মুসলিম খলিফা হজরত উমর রা: তৃতীয়বারের মতো সুয়েজ খাল খনন করিয়েছিলেন, যা প্রায় এক শ’ বছর ধরে দৃশ্যমান ছিল। পরবর্তী সময়ে মিসরের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান মোহাম্মদ আলী পাশা সুয়েজ খালটিকে বর্তমান অবয়বে খনন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
মহৎ মানুষেরা যেমন সব সময় একই কায়দায় চিন্তা করেন তেমনি শয়তান, দুষ্ট ও দুর্বৃত্তরাও একই কায়দায় অপকর্ম করে আসছে সেই অনাদিকাল থেকে। আজকের প্রসঙ্গে আমরা সে দিকে যাবো না। কারণ ভালো ভালো উদাহরণের সাথে মন্দ ইতিহাস বর্ণনা করলে অসতর্ক অবস্থায় যেকোনো পাঠক মহামানবদের চরিত্র, কর্ম ও চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন। আপনারা শুনে অবাক হবেন, প্রকৃতির মহান সৃষ্টিকুলের মধ্যে পৃথিবীর মালিক এমন এক বন্ধন সৃষ্টি করে দিয়েছেন যে, আল্লাহর উত্তম সৃষ্টিগুলো সব সময় একে অপরের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তারা একে অপরের কাছে নিজেকে মেলে ধরে- পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করে, যা সচরাচর মধ্যম সৃষ্টিকুলের মধ্যে কোনো দিন ঘটতে দেখা যায় না।
পৃথিবীর সর্বকালের দুর্গম গিরিপথ হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করার সুযোগ আলেকজান্ডারই পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বহু রাজা বহুবার সসৈন্যে হিন্দুকুশ অতিক্রম করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু প্রকৃতির দয়ায় হিন্দুকুশ পর্বতমালা যেভাবে আলেকজান্ডারের পদতলে নিজেকে সমর্পিত করেছিল, সেভাবে সে আর দ্বিতীয়বার সমর্পিত হতে পারেনি। কারণ প্রকৃতি কোনো দ্বিতীয় আলেকজান্ডার পয়দা করেনি। অনুরূপভাবে তুষারাবৃত ভয়ঙ্কর দুর্গম আল্পস পর্বতমালা সসৈন্যে অতিক্রম করার দুর্লভ সুযোগ পেয়েছিলেন মহাকালের দুই মহামানব। প্রথমজন হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অন্যতম বীর সেনাপতি মহাবীর হানিবল এবং দ্বিতীয়জন হলেন বিস্ময়কর সামরিক প্রতিভাধর মহাবীর নেপোলিয়ান বোনাপার্ট। পাহাড়-পর্বতের মতো সমুদ্রের রাজা-বাদশাহরাও সব সময় তাদের মতো উন্নত শ্রেণীর মানুষজনের জন্য নিজেদের উত্তাল বক্ষ শান্ত করে দিয়েছিলেন। কলম্বাসের মতো মহানায়ক যেমন আটলান্টিক পাড়ি দিতে পেরেছিলেন, তেমনি ম্যাগিলান, ভাস্কো-দা-গামার মতো নাবিকেরা প্রকৃতির অবারিত সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার মাধ্যমেই নিজেদের কীর্তিকে অমর করার সুযোগ লাভ করেছিলেন।
প্রকৃতির দয়াপ্রাপ্ত রাজা-বাদশাহরা কোনো দিন প্রকৃতির অন্য কোনো শ্রেষ্ঠতর প্রাণী অথবা সৃষ্টিকুল দ্বারা আক্রান্ত হননি। কোনো মহান শাসক বাঘ-সিংহ থেকে যেমন আক্রান্ত হননি- তেমনি সমুদ্রেও তাদের সলিল সমাধি হয়নি। রাজারা কোনো দিন বড় বৃক্ষ নিধন করেন না- এবং বাঘ-সিংহ নিধনে নিজেদের বীরত্ব জাহির করেন না। সমুদ্র কোনো দিন পাহাড়কে নিমজ্জিত করেনি কিংবা নদী-সমুদ্রের ভাঙনে পাহাড় ধ্বংস হয়নি। আকাশের বজ্রপাত বটবৃক্ষকে আক্রমণ করে না তেমনি সাহারার প্রবল বালুঝড় কোনো পাহাড়কে আচ্ছাদিত করতে পারেনি বা কোনো দিন চেষ্টাও করেনি। সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা যেমন তুলনামূলক বেশি থাকে- তেমনি পাহাড় যত উঁচু ও বৃহৎ হবে তার মাথা তত ঠাণ্ডা থাকবে।
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে সব ভালো মানুষ কখনো নিজেরা পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-ফাসাদে জড়িয়ে পড়ে না। মহানায়কেরা প্রায় সবাই সমসাময়িককালের হয়ে থাকে এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা-সমঝোতা ও প্রীতিময় সম্পর্ক বহাল থাকে। সময়ের প্রয়োজনে অনেক মহামানব একজন অন্য জন্যের সাথে যুদ্ধ করেছেন বটে- কিন্তু কোনো দিন ভালোমানুষির সীমাটুকু অতিক্রম করেননি। আলেকজান্ডারের সময়কালে যেসব মহান শাসক দুনিয়ার বড় বড় সাম্রাজ্য শাসন করছিলেন, তাদের কারো সাথেই তার যুদ্ধ হয়নি। ভারতের নন্দ বংশ, চীনের শাসকবৃন্দ, উত্তর আফ্রিকা ছাড়াও পশ্চিম ইউরোপে তিনি অভিযান পরিচালনা করেননি। ইতিহাসের প্রায় কাছাকাছি সময়ে আলেকজান্ডার, অ্যারিস্টটল, পোন্টা সক্রেটিস, হিরোডোটাস, সাফাক্লিস প্রমুখেরা পৃথিবীতে ছিলেন। এমনতরো আরো বহু উদাহরণ ইতিহাস থেকে দেয়া যাবে।
বাদশাহ হারুন-আর-রশিদ, সম্রাট সার্লিমেন সমসাময়িক ছিলেন। তুর্কি সুলতান সুলেমান, ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞী প্রথম এলিজাবেথ, মোগল সম্রাট আকবর ও পারস্য সম্রাট শাহ তামসনও ছিলেন সমসাময়িক। মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ডেভিড লয়েড জর্জ, উইনস্টন চার্চিল প্রমুখেরা যেমন সমসাময়িক ছিলেন তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মার্শাল টিটো, জন এফ কেনেডি, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ইয়াসির আরাফাত, গামাল আবদেল নাসের, বাদশাহ ফায়সাল প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের কর্মযুগও ছিল প্রায় সমসাময়িক।
এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, প্রকৃতির মন্দ প্রাণীগুলোও কিন্তু একই সাথে জন্ম নেয় এবং একজন অন্যজনের সাথে পাল্লা দিয়ে দুনিয়ায় তাণ্ডব চালায়। তারা কখনো পরস্পর যুক্তি করে ধ্বংসলীলা চালায়- আবার মন্দলোকের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতেও পৃথিবীতে বহুমাত্রিক ধ্বংসযজ্ঞ সাধিত হয়। এখন যদি প্রশ্ন করা হয়- কেন এমনটি হয়! সে ক্ষেত্রে প্রকৃতির কার্যকারণ নিয়ে বহু গবেষক তাদের গবেষণাপত্র পৃথিবীতে রেখে গিয়েছেন। আপনার জানার আগ্রহ প্রবল হলে সেসব অমূল্য গবেষণা খুঁজে পেতে একটুও কষ্ট করতে হবে না- হাত বাড়ালেই পেয়ে যাবেন একদম নাগালের মধ্যে।
Post A Comment:
0 comments: