সুফিয়ান আহমদ,বিয়ানীবাজার প্রতিনিধিঃ যথাযোগ্য মর্যাদায় বিয়ানীবাজারে পালিত হয়েছে ঐতিহাসিক
নানকার (কৃষক বিদ্রোহ) দিবস। অধিকার আদায়ের চেতনাদ্বীপ্ত প্রতীক হিসেবে ১৯৪৯ সালের
১৮ই আগষ্ট থেকে বিয়ানীবাজারের পালিত হয়ে আসছে দিনটি। প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও নানা
আয়োজনে পালিত হয় নানকার বিদ্রোহ দিবস। নানকার বিদ্রোহ দিবস উপলক্ষ্যে
বিয়ানীবাজারের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন হাতে নেয় নানা অনুষ্টানমালা।
এসব আয়োজনের মধ্যে ছিলো,পুষ্পাজ্ঞ
অর্পন, আলোচনা সভা
ও সাংস্কৃতিক অনুষ্টান।
এদিকে নানকার বিদ্রোহ দিবস উপলক্ষ্যে উপজেলার তিলপারা
ইউনিয়নের সানেশ্বর-উলুউরি গ্রামের মধ্যবর্তি নানকার স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ
করে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে বিয়ানীবাজার সাংস্কৃতিক কমান্ড, নানকার স্মৃতিসৌধ রক্ষণাবেক্ষণ কমিটি, উলুউরি উন্নয়নমুখি যুব সংঘ, সানেশ্বর নানকার স্মৃতি সংঘ উপজেলা
কমিউনিস্ট পার্টি, যুব ইউনিয়ন
ও ছাত্র ইউনিয়নসহ সানেস্বর উলুউরি গ্রামবাসীসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক
সংগঠন। এ বছর পালন হলো নানকার বিদ্রোহের ৬৭ তম দিবস। বিকেলে বিয়ানীবাজার
সাংস্কৃতিক কমান্ড এর আয়োজনে বিদ্রোহস্থলে মঞ্চস্থ হয় নানকার বিদ্রোহ নিয়ে নির্মিত
নাটক “হদ বেগারী” ও আলোচনা
সভা। বিয়ানীবাজার সাংস্কৃতিক কমান্ডের সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদের সভাপতিত্বে ও সাধারণ
সম্পাদক আবিদ হোসেন জাবেদ’র পরিচালনায় আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে
উপস্থিত ছিলেন,উপজেলা পরিষদের
চেয়ারম্যান আতাউর রহমান খাঁন। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন,উপজেলার বিভিন্ন সামাজিক,সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।
উল্লেখ্য, ১৮ আগস্ট ঐতিহাসিক নানকার (কৃষক বিদ্রোহ) দিবস। ১৯৪৯ সালের
এই দিনে মানব সভ্যতার ইতিহাসে জন্ম নিয়েছিল এক নির্মম ইতিহাস। ১৯৩৭ সালের ঘৃণ্য
নানকার প্রথা রদ ও জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে ওইদিন বিয়ানীবাজার উপজেলার সানেশ্বর উলুউরি গ্রামের
সুনাই নদীর তীরে পাকিস্থান ইপিআরের ছোড়া গুলিতে প্রাণ দেন ব্রজনাথ দাস (৫০), কুটুমনি দাস (৪৭), প্রসন্ন কুমার দাস (৫০), পবিত্র কুমার দাস (৪৫) ও অমুল্য কুমার
দাস (১৭) নামের পাঁচজন কৃষক। উর্দু-ফার্সি শব্দ নান-এর বাংলা প্রতি শব্দ রুটি। আর
রুটি বা ভাতের বিনিময়ে যারা কাজ করতেন তাদেরকে বলা হতো নানকার প্রজা। তাই নানকার
আন্দোলন নামেই এটি দেশবাসীর কাছে পরিচিত।
১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্টের প্রায় ১৫ দিন আগে সানেশ্বরে সুনাই
নদীর বুকে জমিদারের লাঠিয়ালদের হাতে শহিদ হন রজনী দাস। এ নিয়ে নানকার আন্দোলনে মোট
শহিদের সংখ্যা হয় ছয়জন। তাদের এই আত্মত্যাগের ফলেই ১৯৫০ সালে তৎকালীন পাকিস্থান
সরকার জমিদারি ব্যবস্থা বাতিল ও নানকার প্রথা রদ করে কৃষকদের জমির মালিকানার
স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। তাই বাঙালি জাতির সংগ্রামের ইতিহাসে, বিশেষ করে অধিকারহীন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে
সকল গৌরবান্বিত আন্দোলন বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কৃষক
বিদ্রোহ বা নানকার আন্দোলন।
বৃটিশ আমলে
সামন্তবাদী ব্যবস্থার সবচেয়ে নিকৃষ্ট শোষণ পদ্ধতি ছিল এই নানকার প্রথা। নানকার
প্রজারা জমিদারের দেয়া বাড়ি ও সামান্য কৃষি জমি ভোগ করতেন, কিন্তু ওই জমি বা বাড়ির উপর তাদের মালিকানা ছিল না। তারা
বিনা মজুরিতে জমিদার বাড়িতে বেগার খাটতো। পান থেকে চুন খসলেই তাদের উপর চলতো
অমানুষিক নির্যাতন।
নানকার আন্দোলনের সংগঠক কমরেড অজয় ভট্টচার্যের দেয়া তথ্যমতে, সে সময় বৃহত্তর সিলেটের ৩০ লাখ
জনসংখ্যার ১০ ভাগ ছিল নানকার এবং নানকার প্রথা মূলত বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে
অর্থাৎ বৃহত্তর সিলেট জেলায় চালু ছিল। ১৯২২ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট
পার্টি ও কৃষক সমিতির সহযোগিতায় বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, বড়লেখা, কুলাউড়া, বালাগঞ্জ, ধর্মপাশা থানায় নানকার আন্দোলন গড়ে ওঠে।
ঐতিহাসিক নানকার বিদ্রোহের সুতিকাগার ছিল বিয়ানীবাজার
উপজেলা। সামন্তবাদী শোষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিয়ানীবাজার অঞ্চলের নানকার কৃষকরা
সর্বপ্রথম বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৯০ সালে নানকার আন্দোলনের শহীদদের
স্মৃতি রক্ষার্থে সুনাই নদীর তীরে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য স্থানীয় জনগণের দেয়া
জমিতে স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন নানকার স্মৃতি রক্ষা
কমিটির সাধারণ সম্পাদক বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। সে সময় স্মৃতিসৌধ
পূর্ণতা না পেলেও দীর্ঘ ৬০ বছর পর ২১ আগস্ট ২০০৯ সালে বিয়ানীবাজার সাংস্কৃতিক
কমান্ডের উদ্যোগে স্থানীয় ও প্রবাসীদের সহযোগিতায় নির্মিত স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন
করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
Post A Comment:
0 comments: