অলনাইন ডেস্ক : খুব বেশি চর্বিযুক্ত খাবারে সঙ্গে আমরা প্রায়শ: কোলেস্টেরলকেও যুক্ত
করি। তবে বেশিরভাগ কোলেস্টেরল; এই মোমসৃদর্শ বস্তুটি তৈরি হয় দেহের ভেতরেই।
রক্তে বহমান কোলেস্টেরলের ৭৫% ভাগই তৈরি হয় যকৃতে। বাকি ২৫% আসে খাদ্য থেকে।
স্বাভাবিক মান বজায় থাকলে কোলেস্টেরল দেহের জন্য সব উপকারী জিনিষ করতে থাকে। তবে
পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য লোকের রক্তে কোলেস্টেরল মান বেশি।
রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে গেলে কোনও লক্ষণ বা উপসর্গ হয়না। কিন্তু
দেহের গভীরে ক্ষতিতো হতেই থাকে। কালক্রমে খুব বেশি কোলেস্টেরল রক্তে ধীরে ধীরে
ধমনীর ভেতর চর্বিপুঞ্জ জমতে থাকে। ধমনী দৃঢ় ও কঠিন হয়ে যায়। একে বলে চিকিত্সা
বিজ্ঞানের ভাষায় ‘এথারোস্ক্রোরোসিস’। এমন হলে করোনারি
ধমনী দিয়ে রক্ত চলাচল ক্ষীণ হয়ে যায়। পরিনতিতে এক সময় হার্ট এ্যাটাক হয়। সুসংবাদ
হলো উচুমান কোলেস্টেরল সনাক্ত করা সহজ। আর একে নামানোরও রয়েছে নানা উপায়।
কোলেস্টেরল টেস্ট
২০ বছরের বেশি বয়স হলে কোলেস্টেরল চেক্ করানো উচিত এবং পাঁচ বছরে
একবার করে টেস্ট করানো ভালো। টেস্টের নাম হলো ফাস্টিং লিপিড প্রোফাইল। ৯-১২ ঘন্টা
উপবাস থাকার পর রক্তের নমুনায় বহমান বিভিন্ন ধরণের কোলেস্টেরল পরিমাপ করা। এই
ফলাফল থেকে পাওয়া যাবে মোট কোলেস্টেরল, ক্ষতিকর কোলেস্টেরল এল.ডি.এল,
হিতকর কোলেস্টেরল এইচ.ডি.এল মান ও ট্রাইগ্লিসারাইড মান।
ক্ষতিকর কোলেস্টেরল
রক্তের বেশিরভাগ কোলেস্টেরল যে প্রোটিন বহন করে একে বলে লো-ডেনসিটি
লাইপোপ্রোটিন বা এলডিএল। একে বলে খারাপ কোলেস্টেরল। কারণ এটি অন্যান্য বস্তুর
সঙ্গে যুক্ত হয়ে অবরুদ্ধ করে রক্তনালী পথ। স্যাচুরেড ফ্যাট ও ট্রান্সফ্যাট সমৃদ্ধ
খাবার বেশি খেলে রক্তে বেড়ে যায় এল.ডি.এল। বেশিরভাগ লোকের ক্ষেত্রে এলডিএল মান
১০০-এর নিচে হলে তা স্বাস্থ্যকর। তবে যাদের হূদরোগ তাদের এলডিএল মান এর চেয়ে কম
হওয়া ভালো।
ভালো কোলেস্টেরল
রক্তের কোলেস্টেরলের প্রায় এক তৃতীয়াংশ বহন করে হাই-ডেনসিটি
লাইপোপ্রোটিন বা এইচডিএল। একে বলে ভালো কোলেস্টেরল। কারণ ক্ষতিকর কোলোস্টেরল
অপসারণে সহায়তা করে এইচডিএল। তাই ধমনীর দেয়ালে এটি জমা হবার সুযোগ পায়না। এইচডিএল
মান যত উঁচু তত ভালো। যাদের রক্তে এইচডিএল খুব কম এদের হূদরোগ হবার সম্ভাবনা বেশি।
স্বাস্থ্যকর চর্বি যেমন জলপাই তেল গ্রহণ করলে এইচডিএল বাড়তে পারে।
ট্রাইগ্লিসারাইড
শরীর বাড়তি ক্যালোরি, চিনি এবং এলকোহলকে ট্রাইগ্লিসারাইডে
রূপান্তরিত করে। ট্রাইগ্লিসারাইড বা চর্বি রক্তে বহমান হয়ে সারা শরীরে মেদকোষে জমা
হয়। যাদের শরীরে ওজন বেশি, নিষ্ক্রিয় যারা, ধূমপায়ী বা মদ্যপায়ী এদের রক্তে অনেক বেশি ট্রাইগ্লিসারাইড। যারা খুব
বেশি শর্করা খান তাদের রক্তেও ট্রাইগ্লিসারাইড বেশি। ট্রাইগ্লিসারাইড মান ১৫০ এর
বেশি হলে ঝুঁকি থাকে মেটাবলিক সিনড্রোমের। এই রোগ সমষ্টির জোরালো সম্পর্ক রয়েছে
হূদরোগ ও ডায়াবেটিসের সঙ্গে।
মোট কোলেস্টেরল
রক্তে বহমান লাইপোপ্রোটিন কনা এলডিএল, এইচডিএল ও ডিএলডিএল একত্রে
হলো কোলেস্টেরল। ক্ষতিকর এলডিএল কনার পূর্বরূপ হলো ডিএলডিএল। ভিএলডিএল তৈরি হয়
যকৃতে এবং তা রূপান্তরিত হয় এলডিএল কনায়। সাধারণত: রক্তে মোটে কোলেস্টেরল মান ২০০
এর নিচে হলে তা স্বাস্থ্যকর। এর বেশি থাকলে হূদরোগের প্রচুর সম্ভাবনা থাকে। মোট
কোলেস্টেরল= এলডিএল+এইচডিএল+ভিএলডিএল।
কোলেস্টেরল অনুপাত
কোলেস্টেরল অনুপাত গণনা করার জন্য মোট কোলেস্টেরল মানকে এইচডিএল মান
দিয়ে ভাগ করতে হবে। যেমন মোট কোলেস্টেরল ২০০ এবং এইচডিএল ৫০; তাই
কোলেস্টেরল অনুপাত হলো ৪:১। চিকিত্সকের পরামর্শ অনুপাতটি ৪:১ বা এর নিচে থাকলো
ভালো। অনুপাত যত কম তত ভালো। এই অনুপাতটি হূদরোগের ঝুঁকি অনুমানে উপকারী। তবে
চিকিত্সা প্রদানে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক নয়। চিকিত্সা দেওয়া ও ফলোআপের জন্য
রক্তের মোট কোলেস্টেরল, এইচডিএল ও এলডিএল মান প্রয়োজন।
খাদ্যে কোলেস্টেরল
কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাদ্য চিংড়ি, গলদা চিংড়ি, ডিমের কুসুম। কিন্তু এগুলো নিষিদ্ধ খাবার নয়। সীমিত পরিমাণে খাওয়া যেতে
পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, যে কোলেস্টেরল আমরা খাদ্যের
মাধ্যমে গ্রহণ করি এর সামান্যই প্রভাব পড়ে রক্তের কোলেস্টেরল মানের উপর। বেশিরভাগ
ক্ষেত্রেই। কিন্তু মানুষের উপর প্রভাব পড়ে বটে। তবে বেশিরভাগ মানুষের জন্য বড় বিপদ
হলো স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্রান্স ফ্যাট। সুস্থ মানুষের দৈনিক কোলেস্টেরল গ্রহণ
মাত্রা হলো ৩০০ মিলিগ্রাম এবং যাদের খুব ঝুঁকি এদের জন্য ২০০ মিলিগ্রাম। একটি
ডিমের কুসুমে আছে ১৮৫ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল।
কোলেস্টেরল এবং পারিবারিক
ইতিহাস
কোলেস্টেরল আসে দুইটি উত্স থেকে। শরীর এবং খাদ্য। দুটোই প্রভাব
বিস্তার করে রক্তের কোলেস্টেরলের উপর। কোন কোন লোক এমন জীন উত্তরাধিকার হিসেবে পায়
যা বেশি বেশি কোলেস্টেরল তৈরি হওয়াকে প্রনোদিত করে। অন্যদের জন্য খাদ্য থেকে
কোলেস্টেরল একটি পথ,
কোলেস্টেরল রক্তে বেড়ে যাওয়ার। স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও কোলেস্টেরল
থাকে প্রাণীজ খাদ্যে: যেমন মাংস, কলিজা, মগজ, দুধজাত দ্রব্য, ডিম
থেকে। খাদ্য ও জীনগত উত্তরাধিকার দুটো মিলে অনেক সময় রক্তে কোলেস্টেরল বাড়ায়।
কিসে বাড়ে ঝুঁকি
lস্যাচুরেটেড ফ্যাট ও কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাদ্য
lউচু কোলেস্টেরল মানের পারিবারিক ইতিহাস
lভারি ওজন বা স্থূল শরীর
lবয়স্ক হওয়া
কোলেস্টেরল ও জেন্ডার
রজ:নিবৃত্তির কার্য পর্যন্ত সমবয়সী পুরুষদের চেয়ে কম কোলেস্টেরল
থাকে মহিলাদের। তাদের রক্তে হিতকরী কোলেস্টেরল এইচডিএলও বেশি থাকতে পালে এর একটি
কারণ হলো স্ত্রী হরমোন ইস্ট্রোজেন। সন্তান ধারণক্ষম বছরগুলোতে নারীদের ইস্ট্রোজেন
মান থাকে তুঙ্গে। এর পর তা নেমে আসে রজ:নিবৃত্তি হলে। ৫৫ বছর উর্দ্দে নারীদের
রক্তে উচু মান কোলেস্টেরলের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
কোলেস্টেরল ও শিশুরা
এমন তথ্য প্রমাণ আছে কোলেস্টেরল রক্তনালী পথে অবরোধ স্বষ্প করতে
পারে শৈশব থেকেই। পরবর্তী জীবনে যা এথারোস্ক্রোরোসিস ও হার্ট এ্যাটাকে পর্যবসিত
হয়। আমেরিকান হূদরোগ সমিতির পরামর্শ শিশু ও টিনএজার যাদের রক্তে উচুমান কোলেস্টেরল, এদের তা
নামানো উচিত। আদর্শ:২-১৯ বছর বয়সীদের রক্তে মোট কোলেস্টেরল ১৭০ এর নিচে থাকা উচিত।
উচুমান কোলেস্টেরল কেন বিপদের
কারণ
উচুমান কোলেস্টেরল হল করোনারি হূদরোগ, হার্ট এ্যাটাক ও স্ট্রোকের
অন্যতম প্রধান ঝুঁকি। আলঝাইমার রোগের ঝুঁকিও উচুমান কোলেস্টেরল। আমরা জানি রক্তে
উচুমান কোলেস্টেরল থাকলে ধমনীগ্রাত্রে চর্বি জমে, অবরুদ্ধ
হয় রক্ত প্রবাহ। হূদরোগে পর্যবসিত হতে পারে তা। হূদপেশির বিশেষ অঞ্চলে রক্ত প্রবাহ
কমে গেলে সে অংশটিতে ঘটে হার্ট এ্যাটাক।
কোলেস্টেরল কমানো চাই
কোলেস্টেরল মান কমাতে খাদ্যবিধি একটি উত্তম পন্থা। আঁশযুক্ত শস্য
বেশ হূদবান্ধব। কিছু কিছু খাবারের দ্রবনীয় আঁশ, রক্তের এলডিএল কমাতে সহায়ক। দ্রবনীয়
আঁশের ভালো উত্স হলো আটার রুটি, লাল ও হোলগ্রেন শস্য,
ওটমিল, ফল, শাক
সবজি ও কিডনি বীনস্।
চিনতে হবে চর্বিকে
প্রতিদিনে মোট ক্যালোরির ৩৫% এর বেশি আসা উচিত নয় চর্বি থেকে। তবে
সব চর্বি যে সমান,
তাতো নয়। স্যাচুরেটেড ফ্যাট তা প্রাণীজ হোক বা উদ্ভিজ তৈল হোক
বেশি গ্রহণ করলে বাড়ে রক্তে এলডিএল এবং কমায় হিতকর এইচডিএল।
এই দুটো মন্দ চর্বি পাওয়া যায় বেকারিতে প্রস্তুত খাদ্য, ভাজা খাবার,
ডোনাট, থ্রাই, চিপস,
স্টিক মার্জাবিন এবং কুকিস বিস্কুটে। অসম্পূর্ন চর্বি কমায়
এলডিএল এবং করে হিতকর কাজও। জলপাইতেল ও পিনাট তেলে আছে তেমন চর্বি।
স্মাট প্রোটিন
মাংস এবং পুরোচর্বিসহ দুধে আছে প্রচুর প্রোটিন। তবে আচে
কোলেস্টেরলও। বরং সোয়াপ্রোটিন খেলে এলডিএল কমার সম্ভাবনা বাড়ে। আর একটি ভালো পছন্দ
হলো মাছ। এতে আছে ওমেগা-৩ ও মেদঅম্ল; হূদবান্ধব। সপ্তাহে অন্তত: দুদিন
মাছ খেতে পরামর্শ আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশনের।
লোকার্বোহাইডেট ডায়েট
এমন তথ্য প্রমাণ আছে যে, কোলেস্টেরলের উচুমান কমাতে লো-ফ্যাট
ডায়েটের চেয়েও লো-কার্ব ডায়েট ভালো। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের দু’বছরের এক গবেষণা
থেকে জানা যায়, লোফ্যাট খাদ্য গ্রহণ করেছেন যারা তাদের চেয়ে লো-কার্ব খাদ্য বা কম
শর্করা খাবার খেয়েছেন যারা তাদের হিতকর এইচডিএল মান অনেক ভালো।
বাড়তি ওজন কমাতে হবে শরীরের ওজন বেশি হলে শরীরে ওজন হ্রাসের
প্রোগ্রাম শুরু করতে হবে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে। বাড়তি ওজন কমালে কমবে
ট্রাইগ্লিসারাইড,
এলডিএল ও মোট কোলেস্টেরল।
মাত্র কয়েক পাউন্ড শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলতেও হিতকর কোলেস্টেরল বাড়ে, ৬ পাউন্ড
ওজন কমালে বাড়ে এক পয়েন্ট।
ধূমপান ছাড়তে হবে
ধূমপান ছাড়া কঠিন হলেও ছাড়তে পারলে অনেক লাভ। ধূমপান ছেড়ে দিলে
হিতকর এইচডিএল বেড়ে যাবে ১০%।
ব্যায়াম হলো ভালো দাওয়াই
সুস্থ আছেন তবে সক্রিয় নন জীবন যাপনে। এমন কেউ যদি এরোবিক ব্যায়াম
প্রোগ্রাম শুরু করেন তাহলে প্রথম দুই মাসের মধ্যেই হিতকর কোলেস্টেরল বেড়ে যাবে ৫%।
নিয়মিত ব্যায়ামে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলও কমে।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক
ল্যাবরেটরী সার্ভিসেস
বারডেম, ঢাকা
Post A Comment:
0 comments: