মিরন নাজমুল, বার্সেলোনা : গত ২৯ মে
রবিবার স্পেনের বার্সেলোনায় অনুষ্ঠিত হলো বাঙালীর প্রাণের উৎসব বৈশাখী মেলা ১৪২৩। দুপুর
২টায় মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে শুরু হয় অনুষ্ঠানের মূল আয়োজন। শিশু, কিশোরসহ সবার
পরনে লাল-সাদার সাজপোশাক, তুলির আঁচড়ে মুখে আঁকা আলপনা, খোঁপায় সাজানো সাদা ফুলের
বাহারে প্রাণবন্ত ছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা।
সবার হাতে ছিল কাগজে তৈরি কলস, ঢোল,
একতারার প্রতীক, পেস্টুন, বেরংয়ের মুখোশ এবং নববর্ষের অক্ষরে ও আলপনায় সজ্জিত
ঐতিহ্যবাহী কুলা। বাংলার ঐতিহ্য লালন করা এই শোভাযাত্রাটি শহরের রাস্তা প্রদক্ষিণ
করে মেলাস্থল প্লাসা মাকবায় এসে জড়ো হয়। মঞ্চস্থলে দেশীয় লোকজ সংগীত ও নাচে
উল্লাশে বরণ করে নেয়া হয় মঙ্গল শোভাযাত্রাকে। তারপর স্থানীয় শিল্পীদের অংশগ্রহণে
শুরু হয় প্রথম পর্বের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গান, কবিতা আবৃত্তি, শিশুদের ফ্যাশন শো,
নাচ ইত্যাদি বিনোদনে জমতে শুরু করে মেলা।
মেলার স্টলগুলোতে সাজানো হয়
বাংলার ঐতিহ্যময় নানা রকমের পিঠা, পায়েশ, চটপটি, পোলাও, ঝালমুড়িসহ বিভিন্ন খাবারে।
বিক্রির জন্য বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঠালও শোভা পাচ্ছিলো স্টলে। সময়ের সাথে আস্তে
আস্তে ভিড় বাড়তে থাকে মেলায়। আসোসিয়াসিয়ন কুলতুরাল ই উমানিতারিয়া
দে বাংলাদেশ এন কাতালোনিয়া'র তত্ত্বাবধানে এবং বার্সেলোনার বিভিন্ন সামাজিক ও
সাংস্কৃতিক সংগঠনের অংশগ্রহনে অনুষ্ঠিত এ মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় বিকাল ৫টায়।
আসোসিয়াসিয়ন কুলতুরাল ই উমানিতারিয়া
দে বাংলাদেশ এন কাতালোনিয়া'র সভাপতি মাহারুল ইসলাম মিন্টুর সভাপতিত্বে বাংলাদেশ
দূতাবাসের কাউন্সিলর ও হেড অব চ্যান্সারী হারুন আল রশিদ লাল ফিতা কেটে মেলার
উদ্বোধন করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বার্সেলোনা পৌরসভার ও কাতালুনিয়ার প্রশাসনিক
কর্মকর্তাসহ স্প্যানিশ মানবাধিকার কর্মীরা। মঞ্চে আমন্ত্রিত হন বৈশাখী মেলা উদযাপন
পরিষদের সদস্যবৃন্দসহ বার্সেলোনার বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের সভাপতি,
সাধারণ সম্পাদক, উপদেষ্টাসহ অন্যন্য নেতৃবৃন্দ।
মেলা আয়োজক সংগঠনের
সভাপতি মেহেরুল ইসলাম মিন্টু, সাধারণ সম্পাদক উত্তম কুমার জানান,
প্রবাসে বাঙালী নব প্রজন্ম যাতে আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়ে বেড়ে
উঠতে পারে, সেজন্যই এ বৈশাখী মেলার আয়োজন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানশেষে শেষ
বিকেলে আর তিলঠাঁই ছিল না, কানায় কানায় ভরে ওঠে মেলা প্রাঙ্গন। প্রবাসী
বাংলাদেশীদের পদচারণায় প্লাসা মাকবাকে তখন মনে হচ্ছিলো এক টুকরো সোনার বাংলাদেশ।
এরপর বাংলাদেশীদের এই আনন্দমূখর পরিবেশে শুরু হয় মেলার প্রধান আকর্ষণ অতিথি
শিল্পীদের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মূল পর্বের এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ
নেন দুই বাংলার জনপ্রিয় বাউল সম্রাট পবন দাস বাউল। বাউল শিল্পী ‘তোমার দিল কি দয়া হয় না’ থেকে শুরু করে আরো কিছু লোকায়ত জনপ্রিয় বাউল গানে
মাতিয়ে রাখেন দর্শকদের। বাংলাদেশের আধুনিক গানের জনপ্রিয় শিল্পি তপন চৌধুরী দর্শক
মাতান তার বিখ্যাত গান ‘আলো ভেবে যারে আমি
জীবনে জড়াতে চাই সে তো আলো নয় যেন আলেয়া’,
‘রসিক আমার মন বান্ধিয়া
পিঞ্জর বানাইছে’ সহ আরো কিছু জনপ্রিয়
গানে। বাংলার পুঁথি শিল্পী কাব্য কামরুল লুঙ্গি গামছা পরে বাবড়ি চুলে স্টেজে আসেন।
মাথা দুলিয়ে গেয়ে যান বাংলার ঐতিহ্যময় পুঁথি গান। বার্সেলোনায় বাংলাদেশী
প্রবাসীদের উদ্দেশ্য স্বরচিত পুঁথি পরিবেশন করেন দর্শকের জন্য। বাংলাদেশের জনপ্রিয়
বাউল শিল্পী ফকির শাহাবুদ্দিন ‘আগে
কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘বন্ধে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে...’সহ চিরায়ত বাংলার জনপ্রিয় ফোকগানের মূর্ছনায় মাতিয়ে
রাখেন দর্শকদের।
এ সময় মঞ্চে ফকির সাহাবুদ্দিনের সাথে পূনরায় যোগ দেন তপন চৌধুরী ও
পবন দাস বাউল। গানের আনন্দে সময় গড়াতে থাকে। রাত ১১টায় শেষ হয় গানের আসর। শুরু হয়
লটারী পর্ব। দু’জন শুভাগ্যবান পান
বার্সেলোনা-ঢাকা-বার্সেলোনা এয়ার টিকেট। আর বাকী দশজন পান আকর্ষণীয় পুরষ্কার। লটারীতে
বিজয়ীদের নাম ঘোষণার পর বাংলাদেশী প্রবাসীদের মিলনমেলার সমাপ্তি টানা হয়। আবার আসবে
প্রাণের মেলা –এই আশায় বুক বেধে সবাই
চলে যায় যে যার প্রবাস জীবনের বাস্তবাতার ভিড়ে।
এছাড়া স্থানীয় শিল্পী ইমরান, বিউটি, জিনাত, তিথী, মঞ্জু, রাজু,
সুমি, বিধান, জিনিয়া, দিবা, বাবু মন মাতানো সাংস্কৃতিক পরিবেশনা উপস্থিত দর্শকরা উপভোগ করেন
হাজারো প্রবাসী বাঙালী।
Post A Comment:
0 comments: