ইকতেদার আহমেদ: ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ
পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা
লাভ করে বিজয়ী হলেও পাকিস্তানের সেনাশাসক নানা অজুহাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয়
ও প্রাদেশিক সরকার গঠনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। এসব কারণে পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ
আন্দোলন শুরু হয়, যা পরে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ লাভ করে। ১৯৭১ সালের
২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলেও কার্যত ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ অবধি পূর্ব
পাকিস্তানে পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা অব্যাহত থাকে। বাংলাদেশের মুক্তি তথা স্বাধীনতা
সংগ্রামের ব্যাপ্তি প্রায় ৯ মাস হলেও ডিসেম্বর ৩, ১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তানের উভয় সীমান্তে
যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ শুরু হয় ১৬ ডিসেম্বর এর অবসানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ
রাষ্ট্রটির অভ্যুদয় ঘটে। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর
৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীর মধ্যে সামরিক ও
আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য, বেসামরিক কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের কিছুসংখ্যক
অন্তর্ভুক্ত ছিল।আমাদের মুক্তি তথা স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে এ দেশে পাকিস্তানি বাহিনী
যে অত্যাচার ও উৎপীড়ন চালায়, তার নেতৃত্বে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দাবি করা হতে থাকে ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের
নিমিত্ত বাংলাদেশের কাছে সমর্পণের জন্য।ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী যথাক্রমে
ইন্দিরা গান্ধী ও জুলফিকার আলী ভু্েট্টার মধ্যে জুলাই, ১৯৭২ সালে হিমাচল প্রদেশের শৈলনিবাস
সিমলায় যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়, এটি সিমলা চুক্তি নামে অভিহিত। চুক্তিটিকে শান্তিচুক্তি
বলা হলেও এটি তারও বেশি অবদান রাখে সৈন্য প্রত্যাহার ও যুদ্ধবন্দী বিনিময়ে। যেসব নীতিমালার
ওপর ভিত্তি করে চুক্তিটি প্রণীত হয়, তা হলো সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণের রূপরেখা, দ্বন্দ্ব
ও বিরোধ মিটানো; যা আগে সম্পর্কের হানি ঘটিয়েছে, স্থায়ী শান্তি, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার
জন্য কাজ করা এবং জম্মু ও কাশ্মিরে ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে যুদ্ধবিরতির কারণে উদ্ভূত
নিয়ন্ত্রণ রেখা উভয়পক্ষ অতীতের সম্মত নিয়ন্ত্রণ রেখাকে উপেক্ষাপূর্বক মেনে চলা। তা
ছাড়া চুক্তিটিতে যেসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। তা হলো- (ক) প্রত্যক্ষ দ্বিপক্ষীয়
দৃষ্টিভঙ্গিতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সব বিষয়ের নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে পারস্পরিক প্রতিশ্রুতি;
(খ) জনসাধারণের সংস্পর্শকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সহযোগিতামূলক সম্পর্কের ভিত রচনা ও
(গ) জম্মু ও কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখার অলঙ্ঘন সমুন্নত রাখা, যা ভারত ও পাকিস্তানের
মধ্যে স্থায়ী শান্তির পথ নির্দেশক। চুক্তিটির আরো উল্লেখযোগ্য দিক হলো, উভয়পক্ষ
নিজ নিজ ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে, একে অপরের অভ্যন্তরীণ
বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে, একে অপরের অখণ্ডতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বগত
সমতার প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করবে এবং বিদ্বেষমূলক অপপ্রচার পরিহার করে চলবে। চুক্তিটিতে
আরো বলা হয়, দু’দেশের সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী
চুক্তিটির অনুমোদন হতে হবে এবং অনুমোদন দলিল হস্তান্তরের দিন থেকে চুক্তিটি কার্যকর
হবে। চুক্তি কার্যকর হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে সৈন্য প্রত্যাহার সম্পন্ন হবে। সিমলা
চুক্তির পরবর্তীকালে ১৭ এপ্রিল, ১৯৭৩ সালে দিল্লিতে ভারত-বাংলাদেশ বৈঠকের পর ঘোষণা
করা হয় যে, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়া সত্ত্বেও উভয় দেশে উভয়ের নাগরিক
আটক থাকার কারণে যে মানবিক সমস্যা উদ্ভূত হয়েছে তার নিরসন জরুরি। ঘোষণার পরবর্তী সময়ে
ভারত-বাংলাদেশ ও ভারত-পাকিস্তান একাধিক বৈঠক হয়। এ সব বৈঠকের ফলে বাংলাদেশের সম্মতিতে
২৮ আগস্ট, ১৯৭৩ সালে ভারত-পাকিস্তান মানবিক সমস্যা নিরসনে চুক্তিবদ্ধ হয়। এ চুক্তিটির
অনুবলে ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩ সালে তিনমুখী প্রত্যাবর্তন শুরু হয়। তিনমুখী প্রত্যাবর্তনের
মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের স্বদেশে ফেরত, বাংলাদেশে আটক পাকিস্তানিদের
স্বদেশে ফেরত এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবন্দী বিনিময়। ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪
সালে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এর পর ৯ এপ্রিল, ১৯৭৪ সালে উপমহাদেশের সম্পর্ক
স্বাভাবিককরণে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়। ইতপূর্বে
২৮ আগস্ট, ১৯৭৩ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সম্পাদিত দিল্লি চুক্তিতে যে ত্রিপক্ষীয়
আলোচনার কথা বলা হয়, তা পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের পর ৯ এপ্রিল, ১৯৭৪
সালে দিল্লি চুক্তিতে সমসার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে সম্ভব হয়। এ চুক্তিটি স্বাক্ষর করার
আগে যদিও আটক বাঙালি ও পাকিস্তানিদের প্রত্যাবর্তন এবং ভারতে অবস্থানরত যুদ্ধবন্দীদের
প্রত্যাবর্তন চলতে থাকে; কিন্তু এ চুক্তি সিমলা চুক্তিটির ব্যত্যয়ে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর
পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার সপক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করে। চুক্তিটির ১৩, ১৪, ১৫ ও ১৬ অনুচ্ছেদগুলো
আলোচনা করা হলে এ বিষয়ে ধারণা স্পষ্ট হবে।অনুচ্ছেদ নম্বর ১৩ তে বলা হয়- উপমহাদেশে পুনর্মিলন,
শান্তি ও বন্ধুত্ব প্রসঙ্গে সরকারগুলোর আন্তরিক আকাক্সক্ষায় তিনজন মন্ত্রীর মধ্যে পাকিস্তানি
১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীর প্রশ্নটি আলোচিত হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এসব
যুদ্ধাপরাধীর বাড়াবাড়ি ও বহুবিধ অপরাধ জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত ও আন্তর্জাতিক
আইন, যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংশ্লেষে প্রাসঙ্গিক বিধান অনুযায়ী
সবার মধ্যে ঐকমত্য হয় যে, ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর মতো যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুরূপ অভিযোগ
রয়েছে, তাদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণপূর্বক জবাবদিহিতার সম্মুখীন করতে হবে। পাকিস্তানের
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, যেকোনো সংঘটিত অপরাধের জন্য তার সরকার গভীর নিন্দা ও
দুঃখ প্রকাশ করে। অনুচ্ছেদ নম্বরর ১৪ তে বলা হয়- এ সংশ্লেষে তিনজন মন্ত্রী পুনর্বাসন
কাজ দৃঢ়ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনটি দেশ যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, বিষয়টিকে সে আঙ্গিকে
দেখতে বলেন। মন্ত্রীরা পুনঃঅবহিত হন যে, স্বীকৃতির পরবর্তীপর্যায়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী
ঘোষণা করেন যে, তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ সফর করবেন
এবং বাংলাদেশের জনগণের কাছে অতীতের ভুলত্রুটি ভুলে গিয়ে ক্ষমা করার আবেদন জানাবেন।
অনুরূপভাবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত নৃশংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী
ঘোষণা করেন, তিনি চান জনগণ অতীত ভুলে যাক এবং নতুনভাবে যাত্রা শুরু করুক। কারণ বাংলাদেশের
জনগণ জানে, কী করে ক্ষমা করতে হয়।অনুচ্ছেদ নম্বর ১৫ তে বলা হয়- উপরিউক্ত ঘটনাবলি বিশেষত
বাংলাদেশের জনগণের কাছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অতীতের ভুল ভুলে গিয়ে ক্ষমা
করার আবেদনের ওপর শ্রদ্ধা রেখে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত
নিয়েছে যে, ক্ষমার নিদর্শনস্বরূপ বিচার নিয়ে আর অগ্রসর হবে না। সিদ্ধান্ত হয়েছে যে,
১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী দিল্লি চুক্তির শর্তানুযায়ী ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়াধীন অন্যান্য
যুদ্ধবন্দীর মতো ফিরে যেতে পারবে। অনুচ্ছেদ নম্বর ১৬ তে বলা হয়- মন্ত্রীরা দৃঢ়
আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, উপরিউক্ত চুক্তি ১৯৭১ সালের দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত মানবিক সমস্যা
নিরসনে দৃঢ় ভিত রচনা করেছে। উল্লেখ্য, চুক্তিটিতে ভারতের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার
শরণ সিং, পাকিস্তানের পক্ষে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমদ এবং বাংলাদেশের পক্ষে
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তিটি স্বাক্ষর-পরবর্তীকালে পাকিস্তানি
১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষমা লাভ করে পাকিস্তান প্রত্যাবর্তন
করেছে। পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পর বাংলাদেশের সাথে এটি প্রথম সরাসরি আন্তর্জাতিক
চুক্তি। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ছাড়া এ চুক্তিটির অপর পক্ষ ভারত। চুক্তিটি পর্যালোচনায়
প্রতীয়মান হয়, বাংলাদেশের সম্মতির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত তাদের হাতে আটক ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে
পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তরে সম্মত হয়েছিল।আন্তর্জাতিক চুক্তির বিষয়ে আমাদের সংবিধানে
যে বিধান রয়েছে তা দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ, ১৯৭৮ দ্বারা সন্নিবেশিত
হয়। সন্নিবেশিত ১৪৫ক অনুচ্ছেদটি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী দ্বারা অনুমোদিত। অনুচ্ছেদটিতে
বলা হয়Ñ বিদেশের সাথে সম্পাদিত সব চুক্তি রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করা হবে এবং রাষ্ট্রপতি
তা সংসদে পেশ করার ব্যবস্থা করবেন; তবে শর্ত থাকে যে, রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন জাতীয়
স্বার্থে তা সংসদে পেশ করার প্রয়োজন নেই, সে ক্ষেত্রে পেশ করা থেকে বিরত রাখা হবে।’ পরে শর্তাংশটি সংবিধানের দ্বাদশ
সংশোধনী দ্বারা সংশোধিত হয় এবং তাতে পূর্বোক্ত শর্তাংশের পরিবর্তে নতুন শর্তাংশ প্রতিস্থাপনপূর্বক
বলা হয়Ñ তবে শর্ত থাকে যে, জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট অনুরূপ কোনো চুক্তি কেবল
সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করা হবে।’ দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষিত হলে ১৪৫ক অনুচ্ছেদটি
সংবিধান থেকে অবলুপ্ত হয় এবং পরে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদটি দ্বাদশ
সংশোধনী-পরবর্তী যে অবস্থায় ছিল, সে অবস্থায় প্রতিস্থাপিত হয়।
আমাদের সংবিধানে আন্তর্জাতিক চুক্তিসংক্রান্ত যে বিধান বর্তমানে রয়েছে, স্পষ্টত তা ’৭২-এর সংবিধানে ছিল না। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হওয়া সত্ত্বেও বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনপূর্বক পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তা সংবিধানে পুনঃসন্নিবেশিত হয়েছে।
বিদেশের সাথে সম্পাদিত কোন চুক্তি জাতীয় নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট এবং কোন চুক্তি জাতীয় নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট নয়, তা নির্ধারণের দায়িত্ব সরকারের। তা ছাড়া রাষ্ট্রপতির কাছে যেকোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি পেশ করার পর রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা সংসদে পেশ করার যে ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, তা-ও সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। আমাদের দেশে অদ্যাবধি একটি নজিরও নেই যে, একটি সরকার কর্তৃক সম্পাদিত কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি সে সরকার অথবা পরবর্তী ভিন্ন কোনো দলীয় সরকার সংসদের মাধ্যমে বাতিল করেছে। ৯ এপ্রিল, ১৯৭৪ সালে সম্পাদিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটি আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় স্বাক্ষরিত হওয়ার পর কার্যকর হয়। এ ধরনের একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি কার্যকরকালীন এ বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা না থাকা সত্ত্বেও তা উপেক্ষা বা অবজ্ঞার সুযোগ যে নেই, এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণের যৌক্তিকতা কোথায়?
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৭৪ সালে যে মুজিব-ইন্দিরা স্থলসীমানা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তা সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী দ্বারা অনুমোদিত হয়। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা না থাকা সত্ত্বেও এ চুক্তিটি কেন বঙ্গবন্ধু সংসদে পেশ করে অনুমোদনের ব্যবস্থা করেছিলেন? এ চুক্তিটির সাথে ভূমি বিনিময় জড়িত থাকায় তাতে সাংবিধানিকভাবে যে ভূখণ্ড সমন্বয়ে বাংলাদেশ গঠিত, এর সংযোজন ও বিয়োজনের আবশ্যকতা দেখা দেয়। এরূপ সংযোজন ও বিয়োজনের পক্ষে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে একমাত্র জাতীয় সংসদই অনুমোদন ব্যক্ত করতে পারে। অনুরূপ চুক্তি বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত থাকাকালে ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮ তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরু ও তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নূনের মধ্যে সম্পাদিত হয়, যা নেহরু-নূন চুক্তি নামে অভিহিত। চুক্তিটিতে ভারত ও পাকিস্তানের ভূমি বিনিময় জড়িত থাকায় ভারতের জনৈক নাগরিক এর বিরুদ্ধে মামলা করলে তা সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। মামলায় আদালত থেকে সিদ্ধান্ত দেয়া হয় যে, চুক্তিটি কার্যকর করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে এবং সে অনুযায়ী ১৯৬০ সালে ভারতের সংবিধানে নবম সংশোধনীর মাধ্যমে চুক্তিটি অনুমোদিত হলেও নানা জটিলতায় এর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এ চুক্তিটিতে অন্যান্য ভূখণ্ড ও ছিটমহল বিনিময়ের পাশাপাশি ১২ নম্বর দক্ষিণ বেরুবাড়ি ইউনিয়ন দ্বিখণ্ডিত করে এর দক্ষিণ অংশ পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত এবং উত্তরাংশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবে মর্মে উল্লেখ ছিল। দক্ষিণ বেরুবাড়ি নিয়ে যে বিরোধ তার মূলে ছিল, ১৯৪৭-এ রেডক্লিফ যে সীমারেখা টানেন তাতে ১২ নম্বর দক্ষিণ বেরুবাড়ি ইউনিয়ন ভারতের অন্তর্ভুক্ত দেখানো হয়; কিন্তু তার লিখিত বিবরণে তা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত দেখানো হয়। বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমানা চুক্তি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হলেও ভারতের সংসদ কর্তৃক চুক্তিটি ৪১ বছর পরে ২০১৫ সালে অনুমোদিত হয়।
যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সাথে সম্পৃক্ত বাংলাদেশের কিছু আইনজ্ঞ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ৯ এপ্রিল, ১৯৭৪ সালে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটি বাংলাদেশের সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত না হওয়ায় চুক্তিটিতে পাকিস্তানি ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করার কথা বলা হলেও তা মেনে চলার জন্য বাংলাদেশ বাধ্য নয়। এখানে প্রাসঙ্গিক যে, চুক্তিটি সম্পাদনকালে আমাদের সংবিধানে আন্তর্জাতিক চুক্তিবিষয়ক কোনো অনুচ্ছেদ ছিল না। তাই ত্রিপক্ষীয় এ চুক্তিটি যে সংসদে পেশ করার বাধ্যবাধকতায় আবদ্ধ নয়, তা সুস্পষ্ট। সে নিরিখে পাকিস্তানি ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রশ্নটি যে মীমাংসিত, তা নিয়ে বিতর্ক অহেতুক বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টির নামান্তর নয় কি?
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান,
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকআমাদের সংবিধানে আন্তর্জাতিক চুক্তিসংক্রান্ত যে বিধান বর্তমানে রয়েছে, স্পষ্টত তা ’৭২-এর সংবিধানে ছিল না। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হওয়া সত্ত্বেও বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনপূর্বক পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তা সংবিধানে পুনঃসন্নিবেশিত হয়েছে।
বিদেশের সাথে সম্পাদিত কোন চুক্তি জাতীয় নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট এবং কোন চুক্তি জাতীয় নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট নয়, তা নির্ধারণের দায়িত্ব সরকারের। তা ছাড়া রাষ্ট্রপতির কাছে যেকোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি পেশ করার পর রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা সংসদে পেশ করার যে ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, তা-ও সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। আমাদের দেশে অদ্যাবধি একটি নজিরও নেই যে, একটি সরকার কর্তৃক সম্পাদিত কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি সে সরকার অথবা পরবর্তী ভিন্ন কোনো দলীয় সরকার সংসদের মাধ্যমে বাতিল করেছে। ৯ এপ্রিল, ১৯৭৪ সালে সম্পাদিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটি আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় স্বাক্ষরিত হওয়ার পর কার্যকর হয়। এ ধরনের একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি কার্যকরকালীন এ বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা না থাকা সত্ত্বেও তা উপেক্ষা বা অবজ্ঞার সুযোগ যে নেই, এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণের যৌক্তিকতা কোথায়?
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৭৪ সালে যে মুজিব-ইন্দিরা স্থলসীমানা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তা সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী দ্বারা অনুমোদিত হয়। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা না থাকা সত্ত্বেও এ চুক্তিটি কেন বঙ্গবন্ধু সংসদে পেশ করে অনুমোদনের ব্যবস্থা করেছিলেন? এ চুক্তিটির সাথে ভূমি বিনিময় জড়িত থাকায় তাতে সাংবিধানিকভাবে যে ভূখণ্ড সমন্বয়ে বাংলাদেশ গঠিত, এর সংযোজন ও বিয়োজনের আবশ্যকতা দেখা দেয়। এরূপ সংযোজন ও বিয়োজনের পক্ষে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে একমাত্র জাতীয় সংসদই অনুমোদন ব্যক্ত করতে পারে। অনুরূপ চুক্তি বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত থাকাকালে ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮ তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরু ও তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নূনের মধ্যে সম্পাদিত হয়, যা নেহরু-নূন চুক্তি নামে অভিহিত। চুক্তিটিতে ভারত ও পাকিস্তানের ভূমি বিনিময় জড়িত থাকায় ভারতের জনৈক নাগরিক এর বিরুদ্ধে মামলা করলে তা সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। মামলায় আদালত থেকে সিদ্ধান্ত দেয়া হয় যে, চুক্তিটি কার্যকর করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে এবং সে অনুযায়ী ১৯৬০ সালে ভারতের সংবিধানে নবম সংশোধনীর মাধ্যমে চুক্তিটি অনুমোদিত হলেও নানা জটিলতায় এর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এ চুক্তিটিতে অন্যান্য ভূখণ্ড ও ছিটমহল বিনিময়ের পাশাপাশি ১২ নম্বর দক্ষিণ বেরুবাড়ি ইউনিয়ন দ্বিখণ্ডিত করে এর দক্ষিণ অংশ পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত এবং উত্তরাংশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবে মর্মে উল্লেখ ছিল। দক্ষিণ বেরুবাড়ি নিয়ে যে বিরোধ তার মূলে ছিল, ১৯৪৭-এ রেডক্লিফ যে সীমারেখা টানেন তাতে ১২ নম্বর দক্ষিণ বেরুবাড়ি ইউনিয়ন ভারতের অন্তর্ভুক্ত দেখানো হয়; কিন্তু তার লিখিত বিবরণে তা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত দেখানো হয়। বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমানা চুক্তি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হলেও ভারতের সংসদ কর্তৃক চুক্তিটি ৪১ বছর পরে ২০১৫ সালে অনুমোদিত হয়।
যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সাথে সম্পৃক্ত বাংলাদেশের কিছু আইনজ্ঞ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ৯ এপ্রিল, ১৯৭৪ সালে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটি বাংলাদেশের সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত না হওয়ায় চুক্তিটিতে পাকিস্তানি ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করার কথা বলা হলেও তা মেনে চলার জন্য বাংলাদেশ বাধ্য নয়। এখানে প্রাসঙ্গিক যে, চুক্তিটি সম্পাদনকালে আমাদের সংবিধানে আন্তর্জাতিক চুক্তিবিষয়ক কোনো অনুচ্ছেদ ছিল না। তাই ত্রিপক্ষীয় এ চুক্তিটি যে সংসদে পেশ করার বাধ্যবাধকতায় আবদ্ধ নয়, তা সুস্পষ্ট। সে নিরিখে পাকিস্তানি ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রশ্নটি যে মীমাংসিত, তা নিয়ে বিতর্ক অহেতুক বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টির নামান্তর নয় কি?
Post A Comment:
0 comments: