ঢাকা: পৃথিবীর সবচেয়ে
দুর্ভেদ্য, সবচেয়ে কোমল, সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত দুরন্ত এক
মানবিক অনুভূতির নাম ভালোবাসা। এই ভালোবাসার জন্ম বা উৎপত্তি কখন, কবে ও কোথায় হয়েছিল আজ পর্যন্ত তা জানা সম্ভব না হলেও এটা যে সবসৃষ্টির
প্রথম কথা, তা নিশ্চিত বলা যায়। পরম করুনাময় অসীম
ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁর সৃষ্টিতে। সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা ও দরদ দিয়ে
গড়েছেন এই মানব জাতিকে। জনম জনম ধরে ভালোবাসা সবকিছুকে তুচ্ছ করে নিজের আসনকে
করেছে সমুন্নত। বছর ঘুরে এসেছে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘ভ্যালেন্টাইন
ডে’ বা ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’
সঙ্গে নিয়ে।
ভালোবাসা
দিবস নিয়ে আলোচনার আগে জেনে নেয়া যাক বিশ্বজয়ী সেই ১৪ ফেব্রুয়ারির উৎপত্তি ও
বিকাশের ইতিহাস। ভ্যালেন্টাইন দিবসের শুরুর কথা নিয়ে রয়েছে অনেক মত। সবচেয়ে
প্রতিষ্ঠিত মতটি প্রদান করেছেন কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান গবেষক, অধ্যাপক
নিওল লেন্সকি। তার মতে, খ্রিস্ট জন্মের আগে রোমানদের ছিল
জয়জয়কার অবস্থা। রোমানরা খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার আগে প্যাগান (পৌত্তলিক)
ধর্মের অনুসারী ছিলেন। প্যাগান ধর্মের লোকজন খ্রিঃ পূঃ চতুর্থ শতকে পূর্বপুরুষদের
মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত লিওপারসালিয়া বা ফেব্রুয়ালিয়া পূজা পালন করতো। এই ফেব্রুয়ালিয়া
অনুষ্ঠানের নামানুসারে পরবর্তীতে মাসটির নামকরণ করা হয় ফেব্রুয়ারি। মাসটির ১৩ থেকে
১৫ তারিখ পর্যন্ত ছিল এই পূজা হতো। পূজার উদ্দেশ্য ছিল দেবতার সন্তুষ্টি অর্জনের
মাধ্যমে পুণ্যতা, উর্বরতা ও সমৃদ্ধি লাভ করা। অনুষ্ঠানের
মাঝের দিনটি ছিল খুবই আকর্ষণীয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি দেবীরাণী জুনোর সম্মানে পবিত্রতার
জন্য কুকুর আর উর্বরতার জন্য ছাগল উৎসর্গ করা হতো। উৎসর্গীকৃত কুকুর ও ছাগলের
রক্তে রঞ্জিত হয়ে যুবকেরা চামড়ার তৈরী সামান্য পোশাক পরতো। তারপর চামড়ার বেত দিয়ে
দেবীর নামে তরুণীদের পশ্চাতে আঘাত করতো। বিশ্বাস করা হতো দেবী এজন্য ওই তরুণীদের
উর্বরতা বাড়িয়ে দেবেন। দিনটির আরও একটি বিশেষত্ব হল, এ
দিনেই পরবর্তী এক বছর আনন্দ দেয়ার জন্য দেবীর ইচ্ছায় লটারির মাধ্যমে তরুণরা তাদের
তরুণী সঙ্গিনীকে পেতেন। প্রথানুযায়ী বড় একটি বাক্সে তরুণীদের নাম লিখে রাখা হতো।
সেখান থেকে তরুণরা একেকটি নাম তুলে পরবর্তী বছর লটারী পর্যন্ত নির্বাচিত যুগল
একসঙ্গে থাকার সুযোগ পেতেন।
খ্রিস্ট
ধর্মের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের ফলে প্যাগান অনুসারীরাও খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত
হতে লাগলেন। কিন্তু বিপত্তি সৃষ্টি হয় এই লিওপারসালিয়া পূজাকে কেন্দ্র করে।
রোমানরা এই প্রথা বাদ দিতে চাইছিল না। এরই মাঝে ২৬৯ সালে ঘটে যায় আরেকটি ঘটনা।
খ্রিস্টান ধর্মযাজক,
সমাজ সেবক ও চিকিৎসক স্টিভ ভেলেন্টাইন ধর্ম প্রচারকালে রোমান
সম্রাট ক্লাডিউয়াস এর নানা আদেশ লঙ্ঘনের দায়ে গ্রেফতার হন। সম্রাটের যেসব আদেশ
তিনি লঙ্ঘন করেছেন তার মধ্যে প্রধানত, রাজার পক্ষ থেকে
সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য যুবকদের বিয়ে নিষিদ্ধ ছিল। কারণ অবিবাহিত সেনারা
যুদ্ধক্ষেত্রে বেশি ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিতে পারতেন। কিন্তু স্টিভ ভেলেন্টাইন গোপণে
এসব সেনাদের বিয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন ও বিয়ে দিয়ে দিতেন। তাছাড়া জনগণকে
ধর্মদ্রোহী করা, সম্রাটের বিপক্ষের যুদ্ধাহত খ্রিস্টান
সৈন্যদের চিকিৎসা করা এবং রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডের জন্য সম্রাটের রোষানলে পড়ে
গ্রেফতার হন। কারাগারে যাওয়ার পর জনগণের সহানুভূতিতে তিনি আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
এই জনপ্রিয় মানুষটিকে দেখার জন্য প্রতিদিন অগণিত মানুষ কারাগারে যেতেন। তারমধ্যে
কারারক্ষীর অন্ধ মেয়ে জুলিয়া ছিলেন অন্যতম। স্টিভ ভেলেন্টাইনের সঙ্গে তিনি প্রায়ই
দেখা করতেন এবং দীর্ঘ সময় তার সঙ্গে থাকতেন। একপর্যায়ে স্টিভ ভেলেন্টাইন আধ্যাত্মিক
চিকিৎসার মাধ্যমে অন্ধ জুলিয়াকে সুস্থ করে তোলেন। জুলিয়াকে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত
করেন। এ সংবাদে ক্ষিপ্ত হয়ে সম্রাট ২৭০ সালের কোন এক সময়ে জনসম্মুখে স্টিভ
ভেলেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। বলা হয়ে থাকে দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। স্টিভ
ভেলেন্টাইন ফাঁসিকাষ্ঠে যাওয়ার আগে জুলিয়াকে একটি চিঠি লেখেন যার শেষে লেখা ছিল ‘তোমার ভেলেন্টাইনের পক্ষ থেকে’।
এ
ঘটনার পর আস্তে আস্তে খ্রিস্টানরা রোম পরিপূর্ণভাবে জয় করে ফেলে কিন্তু ধর্ম
প্রসারের ক্ষেত্রে লিওপারসালিয়া পূজাকে কেন্দ্র করে বিপত্তি ঘটতে থাকে। খ্রিস্টান
ধর্মগুরু ও রাষ্ট্রনায়কেরা ধর্মপ্রচার ও রাষ্ট্রশাসনের ক্ষেত্রে কৌশলী পন্থা
অবলম্বন করে। ৪৯৬ সালে পোপ গিলাসিয়াস রোমান লিওপারসালিয়া বা ফেব্রুয়ালিয়া পুজার
নাম ও পদ্ধতি পরিবর্তন করে নিজ ধর্মের যাজক স্টিভ ভেলেন্টাইনের নামে অনুষ্ঠানের
নামকরণ করেন। শুরু হয় ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ বা ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’ এর পথচলা। কিন্তু লটারীর
কুপ্রভাবের জন্য মধ্যযুগে সমস্ত ইউরোপে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’
উদযাপন দীর্ঘকাল নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে ইংরেজি সাহিত্যের জনক
জিওফ্রে চসার তার পার্লামেন্ট অব ফাউলস(১৩৮২) এর মধ্যে ‘ভ্যালেন্টাইন
ডে’ নিয়ে লেখেন। এরপর উইলিয়াম শেকসপিওয়রসহ খ্যাতিমান
সাহিত্যিকগণ এ বিষয়টিকে সাহিত্যের উপাদান হিসেবে নিয়ে আসেন। ১৬৬০ সালে রাজা চার্লস
টু আবার দিবসটি পালনের প্রথা চালু করেন।
পরবর্তীতে
শিল্প বিপ্লবের ফলে বিষয়টি বাণিজ্যিক উপকরণে পরিণত হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবল
স্রোতে এই বাণিজ্যিক ‘ব্রান্ড’ আজ বিশ্ব অর্থনীতির বড় একটা অংশ দখলে
নিয়ে নিয়েছে। ২০১০ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে এ দিনটি ঘিরে ১ বিলিয়নের বেশি শুধু
ভ্যালেন্টাইন কার্ড বিক্রি হয়েছে। ২০১৫ সালে যা দেড় গুনের বেশি বৃদ্ধি পাবে বলে
ধারনা করা হচ্ছে। অন্যদিকে ইসলামী রাষ্ট্রগুলো ইসলামী শরীয়া ও সংস্কৃতির
প্রতিবন্ধক আখ্যা দিয়ে দিবসটি পালন নিষিদ্ধ করে। ২০১৪ সালে সৌদি আরবের ধর্মীয়
পুলিশ ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ উদযাপনের
দায়ে ১১ জনকে গ্রেফতার করেন। তাছাড়া ইরান, পাকিস্তান,
মালয়েশিয়াসহ ইসলামী বিশ্ব ‘ভ্যালেন্টাইন
ডে’ উদযাপন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। শুধু ইসলামী বিশ্ব নয়,
ভারতেও নিজস্ব সভ্যতা, সংস্কৃতি ও
ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ায় দিবসটি পালনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
বাংলাদেশে
দিবসটি প্রবর্তন করেন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত সাংবাদিক শফিক রেহমান। ১৯৯৩ সালে
যায় যায় দিন পত্রিকায় আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম বিষয়টির আত্মপ্রকাশ ঘটে।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে সেই লিওপারসালিয়া বা
ফেব্রুয়ালিয়া অথবা ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ বাংলাদেশী সমাজে ব্যাপক
জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সমস্ত দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরম রূপ লাভ করলেও দিবসটি ঘিরে
সমগ্র দেশে সাজ সাজ রব উঠেছে। ঠিক এমন সময়ে ফেসবুক, প্রিন্ট
ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে দিবসটি পালনের বিষয়ে চলছে তোলপাড়। উচিৎ-অনুচিৎ, সংস্কৃতি-অপসংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে চলছে যুক্তি-পাল্টা যুক্তি
উত্থাপনের ধুম। আবেগী জাতি হিসেবে আমাদের নিন্দা ও প্রশংসা দুই-ই আছে। ভিনদেশী
কৃষ্টি-সংস্কৃতি আমাদের বড়ই মোহিত করে। এই ক্ষেত্রে উচিৎ-অনুচিৎ বোধ কাজ করে
অত্যন্ত ধীর গতিতে।
‘ভ্যালেন্টাইন ডে’, স্টার জলসা, জি বাংলা প্রভৃতি সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে
বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা। উপরি পাওনা হিসেবে সাংস্কৃতিক উপনিবেশের কবলে পড়ে দেশীয়
কৃষ্টি, সভ্যতা, চলচ্চিত্র সবই
ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অপসংস্কৃতির চরম স্রোতে স্বকীয়তা আজ মৃতপ্রায়। আমাদের
বাংলাদেশীদের জন্য বিষয়টি আরো একটু পরিতাপের এজন্য যে, ঠিক
সপ্তাহের যে দিনটিতে আমরা ভিনদেশী অপসংস্কৃতির একটি শব্দকে নিজের করে লিওপারসালিয়া,
ফেব্রুয়ালিয়া অথবা ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’
উদযাপনে ব্যাকুল হয়েছি। পরবর্তী সপ্তাহের একই দিনে আমরা বাংলার
গর্বিত সন্তান সেজে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে যাব।
মসজিদে-মন্দিরে শহীদদের জন্য প্রার্থনাও করতে যাব। সত্যিই কতো বিচিত্র আমরা!
সামাজিক, রাজনৈতিক,
সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে
অন্ধ অনুকরণ আমাদের নিজস্বতাকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। অগণিত শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে
জননী, জন্মভূমি আমরা ১৯৭১ সালে লাভ করেছি, আমাদের সেই মা আজ বড় ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত,
আহত। প্রতিদিন এই জননী আরও বেশি আহত হচ্ছে। লিওপারসালিয়া,
ফেব্রুয়ালিয়া অথবা ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’
উদযাপন বিষয়ে আমাদের যতটা ব্যাকুলতা, ভিনদেশী
সিরিয়াল আর চলচ্চিত্র নিয়ে আমাদের যে আবেগ অন্তত সেটুকু দিয়ে যদি একটি বার আমাদের
জন্মভূমিকে ভালবাসতে পারতাম! রাজনীতির নায়কদের মাঝে ভালোবাসার সেই অনুভূতিটি
জাগ্রত করতে পারতাম!! তাহলে আমাদের ব্যাথিত জন্মভূমি কিছুটা স্বস্তি পেত। আমাদের
মা আজ বড় বেশী জীর্ণ, শীর্ণ, ব্যাধিগ্রস্ত।
আমরা কি তার পাশে দাঁড়াব না?
এই লেখাটি আমার। প্রকাশ করার সময় আমার নাম ব্যবহার করুন বা না করুন তা খুব একটা ম্যাটার করে না। ম্যাসেজটি ধারণ করেছেন- এতেই আমি খুশী।
ReplyDelete